চার বছরেও বিরোধী দলের পরিচয় পায়নি জাতীয় পার্টি

দশম জাতীয় সংসদের চার বছর পূর্তি হচ্ছে সোমবার (২৯ জানুয়ারি)। এই সংসদে বিরোধী দল হিসেবে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ রয়েছেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদে। দলটির তিন জন সংসদ সদস্য সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। এরমধ্যে একজন মন্ত্রী ও দুই জন প্রতিমন্ত্রী। দলটির ৬ জন সংরক্ষিত নারী সদস্যসহ ৪০ জন এমপি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। মূল আসনের ৩৪ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২১ জনই বিনাভোটে নির্বাচিত।

বিএনপি বিহীন সংসদে জাপার প্রধান বিরোধী দল হলেও গত চার বছরে দলটি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বরং সরকারের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন ছিল এই দলটির। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। সংসদের বাইরে গত ৪ বছরে সরকারের কোনও সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দলটিকে কোনও কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। দলের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের গত ৪ বছরের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালনের ব্যর্থতার কথাই উঠে এসেছে। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন একইসঙ্গে সরকারে অংশীদারিত্ব ও সংসদে বিরোধী দলে থাকার কারণে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

জাপা মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার সময় বার বার বলেছিল, তারা সরকারের অংশ হলেও ‘গঠনমূলক’ সমালোচনায় কোনও ছাড় দেবে না। তবে, গত চার বছরে হাতেগোনা দুই-একটি ইস্যু ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেছে। সেই তুলনায় সরকারের জনবিরোধী বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্যদেরই সোচ্চার হতে দেখা গেছে। এ কারণে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের দলের এমপিদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, তারা বিরোধী দলে রয়েছেন। মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও তারা সরকারকে ছেড়ে কথা বলেননি।’ এদিকে জাপার ভূমিকার প্রশংসা করে সংসদ নেতা বলেছেন, ‘অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশের মধ্য দিয়ে সংসদ চলছে। এই সংসদে এখন কোনও খিস্তিখেউড় নেই। অশ্লীল কথাবার্তা নেই, চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে যে নোংরামি, বাজে কথা, নানারকম শারীরিক করসৎ চলতো, সেগুলো এখন আর নেই।’

এদিকে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কণ্ঠে বার বার নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করতে দেখা গেছে। গত ২২ জানুয়ারি দলের এক যৌথসভায় তিনি বলেছেন, ‘দেশ-বিদেশের মানুষ এখনও জাপা সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল মনে করে। ঘটনা ঘটে গেছে। কিছু করা যাবে না। আমার খারাপ লাগে।’

এর আগেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিকবার বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষদূত ও তার দল মন্ত্রিসভায় থাকায় দলের ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে জনগণ জাপাকে প্রধান বিরোধী দল মনে করে না। দলটি গৃহপালিত বিরোধী দল হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

গত বছরের মাঝামাঝি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতির হার সন্তোষ প্রকাশ করলেও দ্বিমুখী অবস্থানের কারণে দলটির গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করে। ওই প্রতিবেদনে জাপাকে প্রকৃত বিরোধী দলের মতো ভূমিকা পালনে আগ্রহ থাকলে তাদের দ্বৈত অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ শনিবার এক প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দল হিসেবে তারা সফল বলে দাবি করেন। অথচ দলের এই সংসদ সদস্য নিজেই একাধিকার সংসদে দেওয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘জনগণ জাপাকে বিরোধী দল মনে করে না। বিরোধী দল হিসেবে জাপা সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশন খুবই খারাপ।’ গত বছরের বাজেট অধিবেশনে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণ আমাদের বিরোধী দল মনে করে না। মনে করবেই বা কী করে? আমরা কথা বলতে পারি না। আমি ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারি না।’

কিন্তু শনিবার প্রতিক্রিয়ায় কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, অতীতের যেকোনও সংসদের চেয়ে এই সংসদ বেশি কার্যকর। সরকারের তীব্র সমালোচনা, অনিয়মের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা ও প্রতিনিয়ত চাপের মুখে রাখা বিরোধী দলের দায়িত্ব। আমরা মনে করি, বিরোধী দল হিসেবে আমরা তা করতে পেরেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সংসদে গিয়ে সব কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। সরকারের ভালোকাজের আমরা প্রশংসা করছি। আবার মন্দকাজের সমালোচনা করছি। এই সংসদ অতীতের যেকোনও সংসদের চেয়ে বেশি কার্যকর এই সংসদের আমলে সব থেকে বেশি উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা গাইডলাইন দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছি।’ তার দলের ৩ জন সদস্য মন্ত্রিসভার সদস্য হলেও বিরোধী দলের ভূমিকায় কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেও তিনি দাবি করেন।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘অতীতে যেভাবে সংসদ চলেছে, তা সংসদীয় কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না। বরং আমাদের দেখে অন্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, কিভাবে সংসদ কার্যকর করতে হয়।’ গৃহপালিত বিরোধী দল প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার দলের যারা সংসদে আসতে পারেননি তারা, ক্ষোভের বশেই এ ধরনের মন্তব্য করেন।’

জানতে চাইলে জাপার কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘জাপা কার্যত বিরোধী দল নয়। মানুষ আমাদের বিরোধী দল মনে করে না। ববং সরকারের অংশ মনে করে।কাজেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন সম্ভব নয়।’ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ায় বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে মহাজোট সরকারের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের প্রশংসা করার জন্য অনেক এমপি-মন্ত্রী রয়েছেন। বিরোধী দল হিসেবে আমাদের কাজ হচ্ছে, সরকারের সমালোচনা করা। কিন্তু আমরা সেটা না করে প্রশংসাটাই বেশি করে যাচ্ছি।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের অংশ ও একইসঙ্গে নিজেদের বিরোধী দল দাবি করার কারণে জাপার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ভালো নয়। সত্যিকার অর্থে তারা বিরোধী দল, না সরকারি দল, জনগণের মধ্যে এই প্রশ্নটা বার বার চলে আসে। এ কারণে জাপার মধ্যেও এক ধরনের আত্ম-পরিচয়ের সংকট রয়েছে। এ জন্য দলটির নেতারাই বার বার বলে আসছেন, জাপা গৃহপালিত বিরোধী দল।’

আত্ম-পরিচয়ের সংকটের কারণে জাপা দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধী দলের কাছ থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ যে ভূমিকা প্রত্যাশা করে, জাপা তা পালন করতে পারছে না।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন