চীনের নয়া-সাম্রাজ্যবাদের নতুন ঘুঁটি পাকিস্তান!

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ক্রিকেট তারকা ইমরান খান জয়ী হওয়ার পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। দেশটির সম্ভাব্য এই প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ইতোমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। পাকিস্তানে তহবিলের সংকট চরমে এবং দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ভয়াবহ কম।

চীনের কাছ থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার ধার করার পর তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। এটা একটা উচ্চাভিলাষী আঞ্চলিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার কথা।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ)- এর কাছে সহায়তা চাওয়া।
কিন্তু, এইখানেই সমস্যার শুরু। দেশি সমালোচকরা ফান্ডের বা বৈদেশিক অর্থায়নের প্রতি পাকিস্তানের আসক্তি নিয়ে বিলাপ করছেন।

গত ৩০ বছরের মধ্যে ২২ বছরই পাকিস্তান আইএমএফের ১২টি সহায়তা কার্যক্রমের শর্ত পূরণে হিমশিম খাচ্ছিল। আইএমএফের বিভিন্ন কঠিন শর্তের কারণে পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার করা যায়নি বলে মনে করেন তারা। বিকল্প হিসেবে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারে। কিন্তু, তাতে করে ইসলামাবাদের সরকার বেইজিংয়ের কাছে আরো বেশি করে বাঁধা পড়ে যাবে।

এই হিসেবে, চীনের বৈশ্বিক কৌশলের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরীক্ষাগার হয়ে উঠছে পাকিস্তান। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চীনের একেবারে নিজস্ব আন্তর্জাতিক প্রকল্প। এক ট্রিলিয়ন ডলার (এক লক্ষ কোটি ডলার) সমমানের বিশাল এই প্রকল্পের আওতায় ডজন খানেক দেশে সেতু, এয়ারপোর্ট, বাঁধ, রেলপথ অন্যান্য স্থাপনা তৈরিতে বিনিয়োগ করছে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

মালয়েশিয়া থেকে কলম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত চীনের এই উদ্যোগকে ঘিরে থাকা অস্বচ্ছতার কারণে এসব প্রকল্পে ঘুষ, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। অন্তত একটি ক্ষেত্রে বিরাট একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।

এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই প্রকল্পের কারণে কয়েকটি দেশ ঋণে ডুবে গেছে। এর সবচেয়ে কঠিন উদাহরণ হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা। হাম্বান্টোটায় চীনের নেতৃত্বে একটি ব্যয়বহুল বন্দর নির্মাণের জন্য নেয়া ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ দেশটির সরকার পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে, শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ চীনকে ওই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ও এর আশেপাশের ১৫ হাজার একর জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর, চীন একবিংশ শতাব্দীতে ‘ঋণদাতার সাম্রাজ্যবাদী কৌশল’ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ ওঠে।

চীনের কট্টর সমালোচক ভারতীয় বিশ্লেষক ব্রহ্মা চেলানি এক মন্তব্যে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে ঋণের সম্পর্কে যেসব দেশ জড়িয়ে আছে, তারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সার্বভৌমত্ব দু’টোই হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। নতুন এই সাম্রাজ্যাবাদী দৈত্যের লৌহমুষ্টি মখমলের দস্তানায় ঢাকা। কিন্তু, এটা ছোট দেশগুলোর প্রাণশক্তি নিংড়ে নিতে পারে।’

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন ফেয়ার মনে করেন, ৬২ বিলিয়ন ডলারের ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’- প্রকল্পের নাম আসলে হওয়া উচিৎ ‘পাকিস্তানে উপনিবেশ গড়ে চীনকে ধনী বানানোর প্রকল্প’।

চীন ও পাকিস্তান দুই দেশের কর্মকর্তারাই ‘উপনিবেশবাদের’ এই অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিকভাবেই দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, যার অন্যতম কারণ ভারতের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন পাকিস্তানের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যুক্ত হওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তানের পরমাণু শক্তির কারখানা, বিশেষ ‘ইকোনমিক জোন’ বা অর্থনৈতিক অঞ্চল, গদর শহর ও আরব সাগরে ব্যয়সাপেক্ষ বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।

চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘চীনের সহায়তা পাকিস্তানের প্রয়োজন। কারণ, দেশটি বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও দুর্বল বৈদেশিক বাণিজ্যের মোকাবেলা করছে। দেশটির বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে এবং তারা অশিক্ষিত।’

ওই সম্পাদকীয়তে ‘সব সমালোচনা উপেক্ষা করে পাকিস্তানে বিনিয়োগ বাড়ানোর’ চীনের সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।

এদিকে, ইমরান খান হচ্ছেন একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন। তিনি বার বার ‘চীনের আদলে’ পাকিস্তানকে উন্নত করার ইচ্ছা জানিয়েছেন। কিন্তু, বাস্তবে এটা দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। তার বাগাড়ম্বর হয়তো পাকিস্তানের সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা এবং আইএমএফের সহায়তা চাওয়া ও তাদের নির্দেশনা মেনে চলার প্রবণতা নিয়ে হতাশার বহিঃপ্রকাশ।

‘এখানে সব সময় একই রকম ঘটনা ঘটে,’ মন্তব্য করেন সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ও পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, ‘অর্থ সহায়তার আশীর্বাদে সরকার কেনাকাটায় মত্ত হয়ে ওঠে। ব্যয়বহুল প্রকল্পের জন্য উচ্চমূল্যে ঋণ নেয়, এভাবে দেনার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তোলে এবং আরো বেশি ঘাটতির মধ্যে পড়ে। কয়েক বছর পরে আবার আরেকটি সংকট দেখা দিলে আবারো আইএমফের সাহায্য নিতে হয়।’

ইমরান খান এই ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম ঘটাবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু, ট্রাম্প প্রশাসন তাকে এমনটা করতে বাধ্য করতে পারে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত মাসে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আইএমএফ কী করছে তা আমরা পর্যবেক্ষণ করব এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন।’ তার যুক্তি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের টাকায় পাকিস্তানি ঋণের অর্থায়ন করে পরোক্ষভাবে টাকা চায়নাকে দেয়া চলবে না। আইএমএফের অর্থায়নে আমেরিকার ডলারও রয়েছে। এই টাকায় চীনের বিনিয়োগকারীদের তথা চীনকে উদ্ধার করার কোনো যুক্তি নেই।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে চীনের সুযোগসন্ধানী আচরণের কারণে ওয়াশিংটনের আইনপ্রণেতারা আরো সতর্ক হয়ে উঠছেন।

‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য হচ্ছে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে চীন প্রভুত্ব করবে,’ পম্পেও ও ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভ টি মাঞ্চিনকে একটি চিঠিতে এই মন্তব্য করেন দুই দলেরই সিনেটররা।

‘চীন অন্যদেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে জিম্মি করতে চাইছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে তারা তাদের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাইছে। চীনের উদ্যোগের বিপরীতে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য,’ বলা হয় ওই চিঠিতে।

চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মধ্যে পাকিস্তানের জন্য বেছে নেয়ার মতো অল্প কয়েকটি উপায় রয়েছে।

লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সাইন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক তুরাব হোসেন মার্কিন পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসকে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকার দেন, যা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

তুরাব হোসেন বলেন, ‘এরা হচ্ছে দুই মনিব। উভয়েরই সেবা আপনি কিভাবে করবেন?’

পাকিস্তান কাকে বেছে নেয় সামনের দিনগুলোতে এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।

[দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত ইশান থারুরের বিশ্লেষণ, ‘Pakistan may be the next victim of China’s new ‘imperialism.’ অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ মামুনূর রশিদ। ইশান থারুর টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক সিনিওর এডিটর]