চীনে আ’লীগ-বিএনপি নেতাদের বৈঠক ঘিরে ‘রহস্য’

সম্প্রতি তিন দিনের চীন সফরে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। সেখানে তারা একই হোটেলে থেকেছেন, খেয়েছেন এবং চা চক্রসহ নানা বৈঠকে অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। দেশের মাটিতে একসঙ্গে বৈঠকে বসায় অনাগ্রহ। কিন্তু, বিদেশে মধুর সম্পর্ক, সৌহার্দ্যপূর্ণ এই বৈঠক ঘিরে রাজনীতিতে রহস্যের জন্ম দিয়েছে।

টানা দুই বারের মতো চীনের রাষ্ট্রপতি এবং দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় শি জিনপিং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের নিয়ে জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে ১২০টি দেশের ৩০০ রাজনৈতিক দলের ৬০০ প্রতিনিধি অংশ নেন।

বেইজিং সফরে বাংলাদেশ থেকে তিনটি রাজনৈতিক দল আমন্ত্রণ পায়। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জমির, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ হুমায়ুন।

বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন- দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবং বিএনপিপন্থী সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ।

আর ক্ষমতাসীন জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বে ছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া।

গত ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সাম্যবাদী দলের প্রতিনিধি দল বেইজিংয়ের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে। তিন দিনের সফর শেষে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় দেশে ফেরেন এসব নেতারা।

জানা গেছে, ‘সুন্দর আগামীর বিশ্ব গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা’ এই থিমের ওপর ভিত্তি করে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেই।

বিভিন্ন দেশের অর্ধশত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের উন্নয়ন ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গল্প শুনিয়েছে সদ্য চীন সফর শেষ করে আসা আওয়ামী লীগ নেতারা।

একই সঙ্গে বিএনপিও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, দমন-পীড়নের কথা তুলে ধরেছে। দলটিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিও তারা গুরুত্ব সহকারে বহির্বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে।

বিশ্ব রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত এবারের বেইজিং সফর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

বাংলাদেশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা তিন দিন একসঙ্গে একই হোটেলে খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেইজিং সফর থেকে দেশে ফেরা সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং আমরা একই হোটেলে তিন দিন ছিলাম। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কা অত্যন্ত মধুর ছিল বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না।’

দেশে এমন সম্পর্ক দেখা যায় না কেন? এমন প্রশ্নে তিনি অবশ্য কোনো মন্তব্য না করে হেসে দেন।

চীন সফরের বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল বেইজিং। মূল অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, মিয়ানমার, কানাডা, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, নেপাল, ফিলিস্তিন, সুদান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কিউবা, অলজেরিয়া, মালেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ওইসব বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসাও করেছেন বিশ্বনেতারা। সবমিলিয়ে তিন দিনের সফরটি আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বেইজিংয়ের তিয়েন আনমেন স্কয়ারের পাঁচ তারকা মানের গ্রান্ড হোটেলে ছিলেন নেতারা। একই সময়ে একই স্থানে সকালের নাস্তা, দুপুরের ও রাতের খাবার খেয়েছেন তারা।

শুধু তাই নয়, তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বের ফাঁকে একসঙ্গে চা চক্রেও অংশ নিতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের একজন শীর্ষ নেতা মন্তব্য করেন, ‘চীনের রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এমন হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক দেখে একটু অবাকই হয়েছেন।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে জিনপিংয়ের উদ্বোধনী ভাষণের পর বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি।

আলাপকালে আওয়ামী লীগের এক প্রতিনিধি জানান, প্রথম অধিবেশনের পরপরই সু চির সঙ্গে কথা হয় আমাদের। তার সঙ্গে আলাপে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মাধ্যমে একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সকল ধরনের অমানবিকতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বলে জানাই আমরা। জবাবে সু চি আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, আমরা আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পাবে মিয়ানমার।

ওই সূত্রে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা হয়েছে অনুষ্ঠানে। তুরস্ক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আলজেরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের নেতারা তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য চীন ও মিয়ানমারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।