চুনোপুঁটির মৃত্যুদণ্ড আর গডফাদারদের ‘রেহাই’ দেবে এ আইন?

নতুন মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে ইয়াবাসহ কিছু মাদক পরিবহন, কেনাবেচা, ব্যবসা, সংরক্ষণের অপরাধে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে৷ কিন্তু এই আইনে মাদকের গডফাদারদের আদৌ শাস্তির আওতায় আনা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে৷

মন্ত্রিসভা গত সোমবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে৷ প্রস্তাবিত আইনে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মাদক ইয়াবা পরিবহন, কেনাবেচা, ব্যবসা, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তান্তর , সরবরাহ প্রর্ভতি অপরাধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷

মৃত্যুদণ্ডের এই প্রস্তাব ৫ গ্রামের বেশি ইয়াবা বহন, বিক্রি, চোরাচালানে যুক্ত থাকার অপরাধের জন্য৷ ৫ গ্রামের কম হলে সর্বোচ্চ ১৫ বছর ও সর্বনিম্ন ৫ বছর কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷

প্রস্তাবিত আইনে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ডোপ টেস্টে ‘পজিটিভ’ হলে কমপক্ষে ৬ মাস ও সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷ এছাড়া হেরোইন-কোকেনসহ ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত মাদকদ্রব্য ২৫ গ্রাম বা তার বেশি পরিমাণে বহনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷ ২৫ গ্রামের কম বহনে সর্বোচ্চ ১০ বছরের এবং সর্বনিম্ন ২ বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷

যে-কোনো পানীয়তে যদি শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ বা এর বেশি পরিমাণ অ্যালকোহল থাকে, তাহলে সেটি বিয়ার হিসেবে গণ্য হবে৷ এই জাতীয় পণ্য বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে৷ লাইসেন্সের কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে লিখিত প্রদান সাপেক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা পরিশোধ করতে হবে৷

প্রস্তাবিত আইনে আরো বলা হয়েছে, ‘‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ, সরবরাহ, মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও একই ধরনের শাস্তি পেতে হবে৷”

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছেন, ‘‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের আগের আইনটি ১৯৯০ সালে করা৷ ২৮ বছরের পুরনো আইনটির সঙ্গে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সব আইনের সমন্বয় করে নতুন খসড়া তৈরি করা হয়েছে৷ নতুন আইনে এই সময়কালে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷”

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয় ১৪ মে থেকে৷ শুরুতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একদিনে ১২ জন নিহত হওয়ারও রেকর্ড আছে৷ আর শুরুর পর একমাসে মোট নিহত হন ১৫০ জন৷ এখন অভিযান স্তিমিত হয়ে এসছে৷ বন্দুক যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা দু’শ’ ছাড়িয়ে গেছে৷ কক্সবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হককে বন্দুক যুদ্ধে হত্যা এবং সেই ঘটনার অডিও ফাঁস হলে মাদকবিরোধী অভিযানই প্রশ্নের মুখে পড়ে৷

অন্যদিকে মাদক ব্যবসায় পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ জড়িত বলেও অভিযোগ আছে৷ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু সদস্যের কিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ৷ এ ব্যাপারে কিছু পুলিশ সদস্য ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে কর্মরতদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বড় অংশ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ তাছাড়া বাংলাদেশে ‘ইয়াবা সম্রাট’ বলে পরিচিত কক্সবাজারে সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে আটক বা তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷

আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘এখনপ্রচলিত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে গডফাদার বা মাদক সম্রাটদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ রাঘব বোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়৷ প্রস্তাবিত আইনেও তাদের শাস্তির আওতায় আনার কোনো কার্যকর বিধান রাখা হয়নি৷ কারণ, মাদক আইনে ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে এই মামলায় আসামি করতে হলে মাদক তার কাছে বা দখলে পেতে হবে৷ মাদক ব্যবসার যারা নিয়ন্ত্রক বা অর্থ বিনয়োগকারী, তারা মাদক পরিবহণ, সরবরাহ, বিক্রি বা মজুদের কোনোটিই করে না৷ তাই এই আইন তাদের ধরতে পারবে বলে মনে হয় না৷ কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রনে সবার আগে তাদের ধরা প্রয়োজন৷”

তিনি আরো বলে, ‘‘ইয়াবা তৈরির উপাদান হলো অ্যামফিটামিন৷ এখন ৫ গ্রাম ইয়াবা না অ্যামফিটামিন এটা প্রস্তাবিত আইনে পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন৷ কারণ, ৫ গ্রাম ইয়াবা সামান্যই৷ কিন্তু যদি উপাদান অ্যামফিটামিন ৫ গ্রাম হয়, তা অনেক৷ কারণ, ৫ গ্রাম অ্যামফিটামিন থেকে কয়েক হাজার ইয়াবা তৈরি সম্ভব৷ আইনে যদি মাদকসেবী বা যারা পরিবহণ করে তাদেরই ধরা হয়, তা হলে সেই আইন ন্যায় আইন হবে না৷”

তিনি বলেন, ‘‘আর মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বন্দুক যুদ্ধে যেসব নিহতের ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ কারণ, কেউ যদি অপরাধীও হন, তাকে শাস্তি দিতে হবে আইনের মাধ্যমে, অপরাধ বিচারে প্রমাণ করে৷ আর মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ীর একই শাস্তি হতে পারে না৷ যারা মাদকসেবী, তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য আইন প্রয়োজন৷”

১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ৷ আর এখানে এখন মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা নামের উত্তেজক ট্যাবলেট৷ এছাড়া হোরোইন, গাঁজা এবং ফেনসিডিলের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য৷ মাদকাসক্তের সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম৷ মাদকাসক্তরা বছরে মাদকদ্রব্য কেনার পেছনে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে৷

বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কমছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবারই জানা৷ বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়৷ যদি বড় ব্যবসায়ী বলা হয়, তাহলে সেরকম মাদকব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারের বেশি৷ সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন৷ তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন৷ আর মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে হাজার হাজার৷ কোনো কেনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন৷

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইনের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে আইনগুলোই করা হয় চুনোপুঁটি ধরার জন্য৷ যারা মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকে, তারা অনেক শক্তিশালী৷ তাদের ধরার জন্য কোনো আইন করা হয় না৷ পুলিশ বা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সদসদের এটা অজানা নয় যে, এই প্রভাবশালী মাদক সম্রাটরা কারা৷ কিন্তু তাদের ধরা হয় না৷ ধরা পড়ে গরীব মানুষ, যারা পরিবহন বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে৷ আর তাদের ধরেই বাহবা নিতে চায় সরকার৷”

তিনি আরো বলেন,‘‘মাদকবিরোধী অভিযানের নামে যে দু’শতাধিক মানুষকে বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যা করা হলো, এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন৷ আদালতে বিচারের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত না হলে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না৷ কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হতে পারে না৷”

ড. মিজানুর রহমানের মতে, ‘‘মাদক যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এর কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার ব্যবস্থা নেয়া৷ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মাদক পেলে মাদকসেবীরও শাস্তি হতে পারে, আইনে বিধান থাকতে পারে৷ কিন্তু তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ ”

-ডয়চে ভেলে