চেঙ্গিস খানের সমাধির খোঁজ কেন মেলে না?

ঘোড়ায় চড়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন ভয়ংকর যোদ্ধা চেঙ্গিস খান। মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের এই প্রতিষ্ঠাতার ইতিহাস অপহরণ, রক্তপাত, ভালোবাসা ও প্রতিশোধে পরিপূর্ণ।

চেঙ্গিস খান ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন। সাম্রাজ্য বাড়াতে গিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাম্রাজ্য প্রায় দেড় শতক টিকে ছিল।

১২২৭ সালে মারা যান চেঙ্গিস খান। মৃত্যুর পর আরেক উপাখ্যান শুরু হয়। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর সমাধি হয় মঙ্গোলিয়ার কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে।

শোকাহত সেনারা যখন চেঙ্গিস খানের মরদেহ নিয়ে মঙ্গোলিয়ায় ফিরছিল, তখন তারা পথে যাদের দেখা পেয়েছে, তাদেরই হত্যা করেছে। কারণ, তারা সমাধিস্থলের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখতে চায়নি।

এমনকি চেঙ্গিস খানের সমাধির সব চিহ্ন মুছে দেয় সেনারা। এ জন্য তারা সমাধির ওপর দিয়ে এক হাজার ঘোড়া চালিয়ে দেয়।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞরা চেঙ্গিস খানের সমাধি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। মজার বিষয় হলো, চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার আগ্রহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশিদের যুক্ত থাকতে দেখা গেছে। মঙ্গোলিয়ানদের মধ্যে চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার আগ্রহ দেখা যায়নি। তাঁর সমাধি খুঁজতে চায় না মঙ্গোলিয়ানরা।

চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার ক্ষেত্রে মঙ্গোলিয়ানদের অনাগ্রহের কারণে কারও কাছে মনে হতে পারে, এই বীর যোদ্ধা বুঝি তাঁর নিজ ভূমে গুরুত্বহীন। বিষয়টা আসলে তেমন নয়, বরং উল্টোই। এই যেমন মঙ্গোলিয়ার মুদ্রায় পর্যন্ত তাঁর মুখচ্ছবি আছে। ভোদকায়ও মেলে চেঙ্গিস খান। মঙ্গোলিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা বিপুল।

মঙ্গোলিয়ানদের অনাগ্রহের বিষয়টিকে বিদেশি গণমাধ্যম ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। তারা একে একটি ‘অভিশাপ’ হিসেবে বর্ণনা করে। তারা বলে, অভিশাপের ভয়ে মঙ্গোলিয়ানরা চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজে না। এমন বিশ্বাসের কথাও বলা হয় যে, চেঙ্গিস খানের সমাধি আবিষ্কৃত হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এই ভয় থেকেই মঙ্গোলিয়ানরা তাঁর সমাধি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না।

রাশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ডিগ্রি নেওয়া এক তরুণ মঙ্গোলিয়ান এই রহস্যের ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর ভাষ্য, চেঙ্গিস খানের সমাধি না খোঁজের পেছনে মঙ্গোলিয়ানদের মধ্যে কোনো কুসংস্কার নেই। আছে শ্রদ্ধার বিষয়টি। চেঙ্গিস খানই চেয়েছিলেন, তাঁর সমাধি অজ্ঞাত থাকুক। তাঁর এই ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই মঙ্গোলিয়ানরা সমাধি খুঁজতে যায় না। এখন এটা খুঁজতে গেলে তাঁকে অসম্মান করা হবে বলে তারা মনে করে।

মঙ্গোলিয়ানদের আছে দীর্ঘ ঐতিহ্য, আছে গর্ব। চেঙ্গিস খানের ব্যাপারে তাদের অনুভূতি অভিন্ন। অনেক বাড়িতেই তাঁর প্রতিকৃতি ঝোলানো আছে। কেউ কেউ তো নিজেদের এখনো রাজকীয় পরিবারের অংশ বলে বলে মনে করে। বাস্তবিক অর্থে, মঙ্গোলিয়ায় এখনো এক পরাক্রান্ত যোদ্ধার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত চেঙ্গিস খান।

শ্রদ্ধার বিষয়টি বাদ দিলে মঙ্গোলিয়ায় চেঙ্গিস খানের সমাধি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কিছু কারিগরি সমস্যা রয়েছে। মঙ্গোলিয়ার আয়তন বিশাল। জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। তার ওপর দেশটি অনুন্নত। দেশটির ভূপ্রকৃতির মধ্যে একধরনের গোপনীয়তা আছে, যার ফলে সব জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর উলানবাটর স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান দিমাজাভ আরডেনবাটর। চেঙ্গিস খানের সমাধি খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মঙ্গোলিয়ানদের কাছে চেঙ্গিস খান এক মহানায়ক। তাঁর কর্মের মহত্ত্ব আজও মঙ্গোলিয়ানরা হৃদয়ে ধারণ করে। তারা মনে করে, চেঙ্গিস খান শুধু বিশ্বই জয় করেননি, তিনি সভ্যতাও গড়েছেন। মঙ্গোলিয়ানদের হৃদয়জুড়ে শ্রদ্ধার আসনে আছেন এই বীর সেনা। তাই তারা তাঁর সমাধি খোঁজ করতে চায় না।

বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে শাকিলা হক