ছেলেদের শোকে ১৯ বছর ধরে খালি পায়ে হাটেন দুঃখিনী এই ”মা”

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোড়া ভিটের এক কোণে কোলের শিশুকে বাঁচাতে লড়ছিলেন রমা চৌধুরী। নিয়তির কাছে হার মানতে হয় তাঁকে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বড় ছেলে সাগর মারা গেল। এর দুই মাস যেতে না যেতেই মারা যায় মেজ ছেলে টগরও। ছেলেদের দেহ মাটিতে মিশে রয়েছে। তাই পুত্রশোকে জুতা পরা বাদ দেন তিনি। পরে অনিয়মিতভাবে জুতা ব্যবহার করা শুরু করলেও ছোট ছেলের মৃত্যু তাঁকে আবারও তছনছ করে দেয়। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে গত ১৯ বছরে পায়ে আর জুতা তোলেননি দুঃখিনী এই মা।

সন্তানহারা মা রমা চৌধুরী বলেন, ‘আমার ছেলেদের আমি পোড়াতে দিইনি। এই মাটিতে তারা শুয়ে আছে। আমি কীভাবে জুতা পায়ে হাঁটি। পারলে তো বুক দিয়ে চলতাম-ফিরতাম।’

১৯৭১ সালের বিভীষিকা কিংবা সন্তানদের মৃত্যুর ক্ষণ এখনো জ্বলজ্বলে রমা চৌধুরীর মনে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে তাঁর ছেলে সাগরের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। দুরন্ত শিশুটি মিছিলের পেছন পেছন ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ বলে ছুটত। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। অনেক চেষ্টা করেও বুকে আগলে রাখতে পারেননি তিনি। সাগরের মৃত্যুর ১ মাস ২৮ দিনের মাথায় মারা যায় ৩ বছর বয়সী ‍টগরও।

রমা চৌধুরীর বিভীষিকার শুরু প্রথম ছেলের মৃত্যুর সাত মাস আগে। সেদিন ছিল একাত্তরের ১৩ মে (২৯ বৈশাখ)। তাঁর মনে এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে দিনটি। সেদিন তিনি হারিয়েছেন

সম্ভ্রম, বাড়িঘর। ওই বিভীষিকার বর্ণনা রয়েছে তাঁর একাত্তরের জননী বইয়ে। সেখানে লিখেছেন, ‘যখন আমাকে নির্যাতন করতে উদ্যত হলো পাক সেনা, তখন জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার মা ও দুই ছেলে বারবার আকুতি করছিলেন। ছিল আমার পোষা বিড়াল কনুও। তখন আমি মাকে আমার সন্তানদের নিয়ে সরে যেতে বলেছিলাম।’

কী আশ্চর্য মিল! ৪৬ বছর পর গতকাল শনিবার আরেক ১৩ মে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মা দিবসের প্রাক্কালে রমা চৌধুরী কথা বলেন। বলে যান তাঁর আজীবন জীবনসংগ্রামের কথা। ১৯৭১ সালে রমা চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বিদুগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। লেখালেখিও করতেন ছোটবেলা থেকে। যুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে রেখে ভারতে চলে যান তাঁর স্বামী। এরপর তাঁর দুঃখের দিন শুরু।

একাত্তরের জননী বইয়ের মুখবন্ধে রমা চৌধুরী লিখেছেন, ‘পাক হানাদার বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে, যার ফলে নেমে এসেছে জীবনে শোচনীয় পরিণতি। আমার দুটি মুক্তিপাগল অবোধ শিশুর সাধ স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা ভরা জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম…।’

দুই ছেলেকে হারিয়ে রমা চৌধুরীর তখন উদ্‌ভ্রান্তের মতো জীবনযাপন। পাড়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জোটে অপবাদ। সন্তান হারিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পায়ে ঘা হয়ে যায়। স্বজনদের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর অনিয়মিতভাবে জুতা পায়ে দিতে শুরু করেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে তাঁর ছোট ছেলে ২১ বছর বয়সী টুনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আবারও জুতা পরা ছেড়ে দেন তিনি। খালি পায়ে নিজের লেখা বই ফেরি করে বেড়ান। কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে চলতে চান না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ডেকে সহায়তার হাত বাড়াতে চাইলেও বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দেন তিনি।

রমা চৌধুরীর ১৮টি বই বের হয়েছে। তাঁর ছায়াসঙ্গী বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন। খোকন মায়ের মতো সেবা-শুশ্রূষা করেন রমা চৌধুরীর। আলাউদ্দিন খোকন বলেন, বই বিক্রি করেই তিনি চলেন। চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড়ের লুসাই ভবনের চারতলার একটি কক্ষে তিনি থাকেন। একাত্তরে পুড়ে যাওয়া তাঁর বসতভিটা এত দিন অর্থের অভাবে ঠিক করাতে পারেননি। তবে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য একটি সংস্থার কাছ থেকে সম্মাননা হিসেবে অর্থ পেয়েছেন। এ টাকা দিয়ে ৪৬ বছর পর বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামের পুড়ে যাওয়া বাড়ি ঠিক করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।

রমা চৌধুরী পুত্রশোক ভুলে থাকেন পোষা বিড়ালগুলোকে কোলে নিয়ে। তিন-চারটি বিড়াল পোষেন। বিড়ালদের নিয়েই সন্তানহারা এই মায়ের সংসার। শরীর ভালো থাকলে খালি পায়ে কাঁধের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ৭৪ বছর বয়সী এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, কিন্তু তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ, একাত্তর আমাকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।’- প্রথম আলো