গল্প

ছোঁয়া || রুবাইদা গুলশান

রুবাইদা গুলশান : কাঁচের চুঁড়িগুলো আছাড় দিয়ে ভেঙে বসে রইল পুকুরঘাটে,জলের মাঝে পা ডুবিয়ে, এলোমেলো চুল এলিয়ে,এই ভরা সন্ধ্যা বেলা।দূর থেকে দেখা গেল পুকুর থেকে জল তুলে মুখে দিচ্ছে সে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ওর বুকে সন্ধ্যা নামে,সব ফেলে ওকে দেখা যায় এই রূপে,এই একি ঢঙে।খুব কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ওকে।ওর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে করে ও মেয়ে দুঃখ কিসের! তোমার দুঃখ আমায় দিবে?
এখনো পর্যন্ত তার মুখ দেখতে পারিনি শাজিদ। রোজ কাজ শেষে অফিস ফেরার পথে ওকে ঠিক এভাবেই দেখে।কয়েকদিন হলে এই অচিনকূল গ্রামে পোস্টিং হয়ে এসেছে।
কখনো কখনো মনে হয়েছে কাউকে জিজ্ঞেস করবে এইভাবে এই মেয়েটি কি? কিন্তু কেন জানি আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি।কিছুই জানা হয় নি আর।
একদিন সাহস করে জেনেই ফেললে কে এই মেয়েটি।কি তার নাম,কোথায় তার বাড়ি! আজকাল শাজিদ প্রায় সন্ধ্যাবেলা কাটিয়ে দেয় পুকুরপাড়ে বসে বসে। এসবের কোন মানে হয় না।এই বয়সে এসে একজন মেয়ের ফিরে তাকানোর অপেক্ষা,হাস্যকর লাগতে পারে।কিন্তু হৃদয়ের আবেদন অগ্রাহ্য করা কষ্টকর।এই পৃথিবীতে যার জীবনে যা ঘটে অন্য কেউ কি আর তার মূল্য দিতে পারে!মেয়েটির মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে।যত দেখছে শাজিদের আকুলতা তত বাড়ছে।
মেয়েটি জলে পা ডুবিয়ে,অন্যদিনের মত আজও যখন চুড়িঁ ভাঙ্গতে বসেছে আচমকা সেখানে শাজিদ হাজির।হাত দুটো টেনে নিজের বুকের কাছে নিয়ে বলছে আর তুমি চুড়িঁ ভেঙ্গো না,তোমার ফোঁটা ফোঁটা রক্ত আমার দেখতে ভালো লাগেনা।মেয়েটি মুখ তুলে ডাগর চোখে শুধুই তাকিয়ে থাকে।শাজিদ কেঁপে উঠে,অচেনা মেয়ের হাত ধরে রেখেছে এই ভরা সন্ধ্যাবেলায়।
স্থির হয়ে গেছে এই পৃথিবীর চারিধার,শাজিদ আর মেয়েটি যেন বন্দি সময়ে দাঁড়িয়ে, চোখের বিনিময়ে হাজারো কথা এক নিমিষে এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে চলে যায়।শাজিদ তার চলে যাওয়া দেখে,চোখের আড়াঁল হতেই একমূহুর্তে পুরো পৃথিবী একরাশ শুন্যতায় ভরে উঠে।
শাজিদ মেয়েটির বাড়ি যায়।মেয়েটির নাম রুসাফা।
রুসাফা, বয়স আঠারো কি উনিশ হবে,চোখ দুটো ভীষণ মায়ায় ভরা,বোচা নাক,আর সরু ঠোঁট।স্বাস্থ্যের অবস্থা শীর্ণকায়।বাবা জমি চাষ করেন। আর মা গ্রামের অন্য বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করেন।এত কষ্টের মাঝেও রুসাফা পড়াশুনা করে,এস এস সি পরীক্ষা সে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছে।গরীবের মেয়ে, মা বাবা সংসারের খরচ চালিয়ে উঠতে পারছে না। তাই জোর করে রুসাফাকে বিয়ে দিয়েছিল।একমাস থাকার পর রুসাফার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।আর তারপর থেকে রুসাফা বোবার মত হয়ে যায়,কারো সাথে কথা বলে না, রোজ ভরা সন্ধ্যাবেলায় পুকুরপাড়ে গিয়ে আছড়ে চুড়িঁ ভাঙে।
শাজিদ জানেনা চুড়িঁর সাথে তার জীবনের কি সম্পর্ক।তবুও সে ভাবে,রুসাফা তার মনে উঠা বসা করে, রুসাফার ছবি মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারেনা।
রুসাফার বাড়িতে শাজিদের আনাগোনা বেড়ে যায়।রুসাফার বাবা মা বোঝেন শাজিদ কেন আসে!
রুসাফা রোজ জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে,শাজিদ যখন পথ দিয়ে যায়, দুজনের শুধু চোখাচোখি হয় মাত্র।সময়ের সাথে সাথে রুসাফার হাত ভর্তি কাঁচের চুড়িঁ ভাঙার অভ্যাস টা কমেছে।নানান রকমের বাহারী রঙের চুড়িঁ কিনে দিয়েছে শাজিদ।রুসাফা সেই চুড়িঁ পরে অপেক্ষা করে এক পলক দেখার,জলে শুধু পা ডুবিয়ে রাখে।
রুসাফার বাবা শাজিদকে একদিন ডেকে বলেন বাবা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।শাজিদ বলে ঠিক আছে বলেন।কিন্তু রুসাফার বাবা বলেন-কিছু কিছু কথা পথের মাঝে না শোনায় ভালো।বাবা কাল তুমি সন্ধ্যায় আমার বাড়ি রাতের খাবার খেও।শাজিদ বুঝতে পারে রুসাফার বাবা কি বলতে চান।সারারাত এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত কেটে যায়।
আজ সন্ধ্যায় শাজিদের দাওয়াত,রুসাফার বাসায়।আজ শাজিদ তার পথ বদলে ফেলে।যে চোখ দেখার জন্য এই পথ ধরে সে যেতো,কেন জানি তার আজ এই পথ দিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।নানান ভাবনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে
শাজিদ।
শাজিদ বারান্দায় বসে আছে।বাহিরের অন্ধকার মনের অন্ধকারের চেয়ে বোধ করি বেশি নয়।দাওয়াত গ্রহণ করার পর সেটা না রাখা অন্যায়,সেটা শাজিদ খুব ভালো করে জানে।জীবনের অনেক কাজের ব্যাখ্যা হয়না,ব্যাখা ছাড়ায় মানুষ ভালোবেসে ফেলে,ব্যাখা ছাড়াই এমন অনেক কিছুই করে ফেলে যার সঠিক কারণ জানা হয়ে ওঠে না।ব্যাপারগুলো যে ইচ্ছে করে এমনটি নয়।শাজিদ তেমনি, সে রুসাফাকে চাই না যে তা নয়,কিন্তু কেন জানি রুসাফার বাবার সাথে দেয়া কথাটা রাখতে পারে না।
রুসাফার বাড়িতে অনেক মানুষ।হঠাৎ এত মানুষ,একটু এগিয়ে জানতে পারে আজ বিকালে রুসাফার বাবার আকস্মিক মৃত্যু।রুসাফা কোথা হতে ছুটে আসে, এত মানুষের মাঝখানে এসে সে শাজিদের দেয়া সব কাঁচের চুঁড়িগুলো হাতের মাঝে গুঁজে দেয়।শাজিদের পায়ের কাছের চারপাশটা লাল,নীল,সবুজ বাহারী কাঁচের চুড়িঁ এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে।
চারিদিকের অনেক মানুষের চোখগুলোকে মনে হয় যেন শত শত চোখ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাজিদের দিকে।প্রতিটা চোখ যেন ব্যঙ্গ করে বলছে গরীবের আবার স্বপ্ন কিসের,তুই খুনী,শাজিদ তুই খুনী।
শাজিদ দূর থেকে তাকিয়ে দেখে রুসাফা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে,অথচ তার চোখে কোন জল নেই।
বেশ কয়েকমাস হল শাজিদ বদলি হয়ে এসেছে অন্যগ্রামে।রুসাফাকে মনে পড়ে তার।মনে পড়ে তার পলক ফেলা অবুঝ চোখের চাহনি।
খুব ইচ্ছে করে রুসাফাকে তার নিজের করে পেতে।
কিন্তু এই সমাজ তো তাকে কত কথা বলবে,এত মেয়ে থাকতে তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে বিয়ে করবে,দেশে কি মেয়ের আকাল পড়েছে,সে তো এর চেয়ে ভালো মেয়ে পেতে পারে যে আরো সুন্দর।নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রাণ চলে গেল রুসাফার বাবার। নিজেকে চিনি বলে যতটা না জানি,তার চেয়ে কম জানি আমার আমিকে।কি মুখ নিয়ে রুসাফার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে শাজিদ।
বহুদিন পর অচিনকূল গ্রামে এসেছে শাজিদ।দেরি না করে চলে যায় রুসাফার বাড়িতে। এসে দেখে কেউ একজন শুয়ে আছে ঘরের লাগোয়া বারান্দায়।কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে ,শুয়ে আছে তার রুসাফা।
শীর্ণকায় দেহ আরো শুকিয়ে গেছে, শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কপালে হাত রাখে শাজিদ। শাজিদের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ে, শাজিদ কাঁদছে। সেই জলের ফোঁটা রুসাফার গালে গিয়ে পড়ে, রুসাফা খুব কষ্ট করে চোখ মেলে, তাকিয়ে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে। শাজিদ রুসাফার হাতে হাত রেখে বলে আমায় ক্ষমা কর রুসাফা, তোমায় গ্রহণ করিনি বলে।
আমি তোমায় নিতে এসেছি, তুমি থাকবে আমার সাথে আমারি বউ হয়ে, দু’হাত ভরা কাঁচের চুঁড়ি পরে রিনিঝিনি শব্দে আমার হৃদয় মাতিয়ে দিবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি রুসাফা। ক্ষমা কর, বলতে এত দেরি হল বলে!
রুসাফা তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আর একটি বার চোখ খুলে, খুব কষ্ট করে প্রথমবারের মত বলে উঠে শাজিদের সাথে একটি কথা-শাজিদ তার কান রুসাফার মুখের কাছে নিয়ে যায়-খুব ক্ষীণ সুরে শুনতে পায় রুসাফা বলছে ” ভালোবাসি।” শাজিদের কানে বাজতে থাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি…।
এরপর আর কোন দিন কেউ রুসাফাকে পুকুরজলে পা ডুবিয়ে, চুল এলিয়ে বসে থাকতে দেখিনি। রুসাফা বসে আছে এই পৃথিবীর অন্য কোথাও।