ছোট ছেলে || রুবাইত হাসান

পরিবারের ছোট ছেলে ছেলেটির নাম রুদ্র। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান । বাবা নেই। বড় ভাই একজন সরকারি চাকরিজীবি একাট বোন আছে মিম মণি। সে অবশ্য রুদ্রর ছোট। আর মা সে তো গৃহিনী। রুদ্র এবার তৃতীয় বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষে উঠবে। রুদ্রর বড় ভাই তার বউ কে নিয়ে যদিও আলাদা খায় তবে বাড়ির সন্তান বলে কথা। তাই তিনটি ঘরের একটি ঘর তাকে দিতে হয়েছে। এখানেই থাকে ওরা। মাঝে মধ্যে বড় বড় মাছ মাংস রান্না হলে রিমির হাতে তরকারি পাঠায় রুদ্রর ভাবি। ও রিমির কথা তো বলাই হয়নি। রিমি হচ্ছে বড় ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে। ক্লাস ২য় পড়ে। বাপরে কি পাকনা মেয়ে কমর দুলিয়ে নাচতে পারে। গান গাইতে পারে। কালেমা, কিরাত বেশ পারে। এগুলোতে গুরু তার নানু। আর কি পাকনা পাকনা কথা মাকে বলে তুমি কেন আমার আম্মু অন্য কেও তো হতো। তোমার বাবা কি আমার আব্বুর কাছে তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি কিন্তু বিক্রি হবো না হুম। আরও কি কি ওত্তগুলো মনে নেই।

রুদ্র একটি মেয়েকে পাগলের মতো ভালবাসে। মেয়েটি পাশের গ্রামের মাতবার মেম্বারের মেয়ে। প্রচন্ড মেধাবী ছাত্রী। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এ+ সাথে বৃত্তিও পেয়েছে। এসএসসিতে আবার পেয়েছে গোল্ডেন এ+ । আদরের দুলালি মা বাবার একমাত্র কন্যা। রুদ্রর ভাষ্য মতে মেয়েটি হবুহু নায়কা শাবনুর এর মতো। তবে এটি অবশ্য বরাই করে বলার অন্যতম কারন হলো রুদ্রর ফেস চেহারা অনেকটাই নায়ক রিয়াজের সঙ্গে মিলে। ছোট বেলায় সাদা কালো টিভিতে কতই না ছবি দেখলাম রিয়াজ শাবনুরের। আসলেই শিকার করতে হয় এক অনন্য জুটি ছিল এই নায়ক নায়িকা।

যাই হোক মেম্বারের মেয়ে হওয়াই এলাকার মানুষজন যেমন নোলককে চিনে ( মেয়েটির নাম )। তেমনি তার আবার রূপের বরাইও রয়েছে। এলাকার অনেক পোলাপাইন ফিটিং দেওয়ার জন্য পিছন পিছন ঘুরে তার। এই বাজারে রুদ্র তো ডাল ভাত। এখনও বলেনি কিংবা হয়ত বরতে পারে নি। কারণ বুকে বল নেই যখন কি করবে আর বাহুস্বর। রুদ্র একটি শোরুম এ চাকরি করে ঢাকায়। গ্রামের মানুষদের মধ্যে রুদ্রর বাবার সাথে যার সবচেয়ে মিল বা একত্বা সে হলো আকবর চাচা। আকবর চাচার ছেলে হচ্ছে নিলাভ। নিলাভ ঐ কোম্পানির হেড অফিসে চাকরি করে। রুদ্রর বাবার ফরিয়াদে নিলাভ রুদ্রকে চাকরিটা দিয়েছিল। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শোরুমেই থাকেই সে। তবে শোরুম মেনেজার আকতার খুবই আন্তরিক একজন মানুষ। তাই রুদ্রর ভালোই হতো ভাসির্টি যাওয়া। রুদ্র তার খাতার কভার পুরোটা জুড়ে লিখে রেখেছে ( public ) university , ( public ) univercity, ( public ) ) university । এটা কেন সে লিখে রেখেছে তার কারণ হচ্ছে সে যে) university ( public ) university’i ছাত্র হতে পেরেছে এটা সে একটা যুদ্ধজয় হিসাবেই মনে করে। এই জয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জণ। বড় ভাই যেমন কোন টাকা পয়সা যেমন মাকে দেয় না তেমনি রুদ্রকেও না। রুদ্রই মাস শেষে বেতনের সিংহ ভাগটাকা পরিবারকে পাঠায়। আবার বাড়তি চিন্তা রয়েছে ছোট বোনটাকে আবার বিয়ে দিতে হবে। মা সে টাকা দিয়ে বিয়ে দিবে বা তার ব্যবস্থা করবে তার কোন আস্থা নেই। আরও আস্থা নেই বড় ভাইয়ের উপর।

তাই এটাকে একদম কর্তব্য হিসাবেই নিয়েছে রুদ্র। মাঝে মধ্যে বাসায় যায় রুদ্র। তখন ছোট বোনটার জন্য কসমেটিক নিয়ে যেতে হয়। রিমির জন্য নিয়ে যেতে হয় পুতুল বিভিন্ন খেলার উপকরন। এগুলো না নিয়ে গেলে বোনটির মন খারাপ হয়। আর রিমি তো কেঁদেই দেয়। মন জোগাতে তাই নিজের ফ্লেক্সিলোড আর পকেট খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে ঠিক ঠাক দায়িত্ব পালন করে ছেলেটা। সামনে ইয়ার চেন্জ পরীক্ষা ফরম পূরণ করতে হবে। রুদ্রর কিছু বই পর্যন্ত এখনও কেনা শেষ হয়নি। কারন গেলমাসে খালাতো বোনের বিয়ে ছিল। বেতন ছাড়াও বেশ কিছু অতিরিক্ত টাকা নিয়েছিল সে। কারণ মান সম্মান রক্ষার্থে যেহেতু তার মা ফারিয়ার ( খালাতো বোনের নাম ) খালা বেশ চিন্তা পরিবারের ছোট ছেলেটির । দাদার দুই ছেলে আর চার মেয়ে ছিল। বাবা তিন ঘর আর চাচা তিনটি ঘর পেয়েছে। ঘরগুলো দাদার আমলেই করা। বেশ পুরাতন। ফুপিরা এলে এগুলোতেই রুদ্রদের সাথে শেয়ার করে থাকে। রুদ্রর চিন্তা আছে বিয়ে- সাদি পরে। আগে এগুলো গোছাতে হবে। তাই এই দায়বদ্ধতাগুলো থেকে নোলক কে প্রস্তাব দিতে একরকম ভয়ও করে রুদ্র। যাইহোক এক বন্ধুর কাছে পরামর্শ চেয়েছে তার কথা মনের কথা বলে দে। অতন্ত জানতেতো হবে। সে তোর সঙ্গে সম্পর্ক করবে কি না । করলে করবে না করলে বেটা চিন্তা বাদ। অযথা পেইন নিয়ে লাভ আছে। আর গার্লফ্রেন্ড তো একটা পেইন। আস্ত বড় একটা পেইন। তাই রুদ্র ভাবছে সে এবার নোলককে বলেই ফেলবে সে তাকে ভালবাসে।

কয়েকজনার কাছে তথ্য সংগ্রহ করেছে রুদ্র। নোলক নীল রং পছন্দ করে। চটপটি আর চালতার আচার খেতে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় তাকে। দেব তো যেন তার সপ্নের পুরুষ। দেবের এমন কোন সিনেমা নেই যে নোলক দেখে নি। কোয়েলের ডায়লগগুলো তো তার আবার হজবরল! রুদ্র বাসায় এসেছে বৃহ:পতিবারে। শুক্রবারে নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়া সেরে বড় ভাইয়ের বাইক নিয়ে বের হয়েছে রুদ্র। মনে হচ্ছে যেন এভারেস্ট জয় করতে যাচ্ছে ছেলেটা। রাস্তার পাশেই নোলকদের বাসা আবার জানালার পাশের রুমটা নোলকের। জানালায় আবার আয়না হাতে দাড়িয়ে মেকাপ করে মেয়েটা। যদিও একই স্কুলে পড়েছে কিন্তু কয়েক বছরের সিনিয়র হওয়াই রুদ্র এবং তার পরিবার নিয়ে খুব একটা জানা নেই নোলকের। রুদ্র জানালার পাশে যেতেই দেখল পানির কলস কমড়ে নিয়ে হেঁটে আসছে নোলক। রুদ্র ভাবছে কি বেপার নোলকদের বাসায় টিউবয়েল টেপ সবই আছে তাহলে……. আসলে বিষয় হলো টেপ লাইন নিয়ে কিসের একটা ঝামেলা হয়েছে। আর টিউবয়েলটা নষ্ট হয়েছে। কি লাগছে মাইরি। খাস গ্রামের মেয়ে। চিনতে পেরেছে নোলক এই রুদ্র ভাই কেমন আছেন। আঃ আঃ করতে করতে ভাঙ্গা গলায় উওর দেয় রুদ্র। হে ভালো আছি। তুমি কেমন আছো। জ্বী ভাল আছি। পড়াশুনা কেমন চলছে নোলক। জ্বী বরাবর ও তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। জ্বী বলেন, রুদ্র বলল না তুমি কালতো কলেজে যাবে আমি আবার মিম মণির পরীক্ষার ফি দিতে যাব। তাই দেখা হবে ওখানেই বলব। স্কুল আর কলেজটা একজায়গায় আর হয়ত ভাবছেন রূপের বরাই করা মেয়েটা কেন নিজেই আগে রুদ্রের সঙ্গে কথা বলতে গেল। কারণটা হলো গ্রামের বেশি লোক যে ঢাকায় থাকে তা কিন্তু না। তাই এদিক থেকে যেমন একটা বাড়তি কদর রয়েছে। তাছাড়া রুদ্র চাকরি করে। এখন আবার দেখছে বাইকের উপরে বসা। এক রকম ভালও লেগেছে নোলকের মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। রুদ্র আবার বাইক নিয়ে চলে গেল কিন্তু ও করল কি এমন ভাব যেন কোন কাজে যাচ্ছিল। যেতে রাস্তায় দেখা হয়েছে এখন কাজেই যাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে ১০-১২ কিলোমিটার ঘুরে বাসায় আসতে হলো তাকে। পরদিন সকালে বড় ভাই বাইক বের করেছে। বউ বাচ্চা নিয়ে শশুর বাড়ি যাবে বলে। ঝাঁকি মারতেই দেখে একটুও তেল নেই। অথচ কালকেই তুলেছে ২ লিটার তেল। বিষয়টা হলো টেংকি ফুটো হয়ে সব তেল পড়ে গেছে।

রুদ্রর ভাবি ঘর থেকে জোরে জোরে কি হয়েছে গো। বাইরে এসে যখন শুনে এই কাহিনী সোজা রুদ্রর রুমে গিয়ে কাঁথা তুলে ওর টি শার্টের কলার ধরে বলে ওঠে হারামজাদা টাংকি মারতে গিয়েছিলি না। ভদ্রলোকের মতো তেল এনে দে সব তেল পড়ে গেছে। সাইকেলে চড়ার সামর্থ নাই সে আবার চড়তে গেছে মোটরসাইকেলে। কুত্তার পেটে কখনও ঘি সহ্য হয় না কি। রুদ্রের কাছে খুব বেশি একটা টাকা নেই। ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। তাছাড়া এমাসের বেতনের যে টাকাটা পাবে খাওয়া দাওয়া হসটেল খরচ বই কেনা ফরম পূরণ নিজের যে প্রয়োজনগুলোও সারতে পারবে না রুদ্র। যাই হোক কতটুকু তেল ছিল এটা ভাবিকে জিজ্ঞেস করতেই রুদ্রকে বলে ওঠে ৫ লিটার পুরো ৫ লিটার তেল ছিল। রুদ্র চোখ ডলতে ডলতেই কাসেম চাচার দোকানে যায়। কাসেম চাচাকে বিষয়টা জানালো বাঁকি নিবার জন্য, কিন্তু কাসেম চাচা বেশ কিছু টাকা পায় রুদ্রর কাছে। রুদ্রই বাসাতে বলে গিয়েছিল যখন কিছু লাগবে টাকা না থাকলে কাসেম চাচার দোকান থেকে নিয়ে যেতে। সে টাকা পরিশোধ করে দিবে। মাঝে মধ্যেই যখন রুদ্রর মা কাসেম চাচাকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা ওভাই বাঁকিটা কত হলো। কাসেম চাচা বলে না কোন বাঁকি নাই। রুদ্র টাকা পাঁঠায়ে দেই। আসলে রুদ্র যদিও টাকা পাঠিয়েছে কিন্তু তারপরেও বেশ কিছু টাকা বাঁকি পড়ে গেছে। রুদ্রই আবার বলেছে কাসেম চাচাকে যে বাসায় বাঁকির কথা না জানায়। কাসেম চাচা জানায় কিছুদিন পর তার হালখাতা আরও বলে এখন তো তোমার হালখাতার কার্ড আমি তোমার বাসায় দিতে পারুম না বাজান। আমারে টাহা কয়টা দিয়া যাও। রুদ্র আর কিছু না বলে ওঠেগেল বাসায়। পকেটে যে কয়টা টাকা ছিল এনে কাসেম চাচাকে দেয়। আর পুরো ৫ লিটার তেলটা বাঁকি নিয়ে যায়। রুদ্রর এখনকার চিন্তা শুধু যে ওকে তো আগে ঢাকায় ফিরতে হবে। কিন্তু কিভাবে ফিরবে কারণ তার কাছে তো কোন টাকা নেই। স্কুল লাইফের বন্ধুগুলোর মধ্যে অনেককেই ফোন দেই রুদ্র। কারোটা বন্ধ তো কারোটা বিজি। কেও কেও ওয়েটিং তো আবার কেও কেও ফোনই রিসিভ করেনি। ভাগ্যবসত যাদের সঙ্গে কথা হয় তারা জানাই দোস্ত বাচেলর লাইফ বুঝিসতো। ফোনে কথা বলার সময় রুদ্রর মা কথা শুনতে পেয়ে যায়। রাতে রুদ্র যখন ঘুমাতে যাবে এমন সময় মা এসে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করে বাবা তুই কবে যাবি। রুদ্র চুপ করে আছে বোবা হয়ে। মা আবার জিজ্ঞেস করে রুদ বাবা তোর কবে যেতে হবে । এবার রুদ্র ভাঙ্গা কন্ঠে জানায় কাল রাতেই মা। কারন ছুটি শেষ মা । তার ঘরের আলমারির পরদাটা রুদ্রকে খুলতে বলে । রুদ্র ওটা নামাই তারপর সেলাইটা ব্লেট দিয়ে কাটতে যাবে এমন মূহুতে মা দেখে ছিদ্র ছিদ্র। এটা নিশ্চয় আলোক ধরার ( এক ধরনের ছোট ইঁদুর) কাজ। মা আতংকিত হয়। খুব দ্রুততার সাথে সিলাইটা ছিড়তে থাকে। তারপর মিলে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা নোটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা। রুদ্র জানেই না কি। কি এগুলা আর এসব কি হচ্ছে। মা নিথর হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে। এ টাকাগুলো যে তার কজিার টুকরা রুদ্রর। রুদ্র যখন বাসা থেকে চলে যেত । তখন এ নোট গুলো দিয়ে বলত মা একটা শাঁড়ি নিয়। মা ফল খেও । মা ডাক্তার দেখাইয়ো। জনম দু:খিনি মা একটা টাকাও খরচ করে নি। মা টাকাগুলো ওখানে পুরেছে। এ বার বেশ কয়েকমাস রুদ্র বাসায় আসে নি বলে পর্দার সেই সেলাইটাও আর খোলা পড়ে নি। রুদ্রর আর বোঝার কিছু বাঁকি রইল না। আর্তনাদ ডুকরে ডুকরে আর্তনাদ। রুদ্রর গায়ের চামড়া টেনে ছিরলেও হয়ত ওতটা কষ্ট হবে না। মা বোবা হয়ে শুধু রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ঝরণার মতো চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরছে। রুদ্র এক সময় টের পায় হাত পা অবশ হয়ে আসছে মায়ের নড়া চড়া করছে না। ভাইকে ফোন দেই বাসায় এসো মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভাই জানায় সে শশুর বাড়িতে এখন রাত হয়েছে কি ভাবে যাবে? তাই বললো ভ্যানে করে নিয়ে যেতে, পরে ভাড়াটা দিবে বলেই ফোনটা কেটে দেয়। কিন্তু রুদ্রর কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। রুদ্র যেভাবে হোক ম্যানেজ করবে ভেবে যখন পাখির মতো একপ্রকার উড়ে এসে যখন গ্রামের মোড়টাতে পৌঁছে তখন ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় রাত ১০টা। ডিসেম্বর মাস, কনকনে শীত! জনমানবশূন্য! চারদিক দিকে শিয়াল কুকুরের ভয়ঙ্কর সব আওয়াজ। এক ভূতড়ে পরিবেশ। রুদ্র এবার ভেবে নেয় মাকে কোলে করে ৮-১০ মাইল দূরে হাসপাতালে নিয়ে যাবে ও পিছন ফিরে দৌড় দেয়। অর্ধেক রাস্তা আসতেই আকতার চাচা ফোন দেয়। রুদ্র ভাবছে ঢাকায় ফিরার ব্যাপারে কথা বলবে এ সময় ও কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই রিসিভ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার ফোন রিসিভ করেই রুদ্র রাগে ক্ষোভে কন্ঠে বলে উঠে কি হয়েছে? হয়েছেটা কি? আকতার শুনেছে কিন্তু না শুনার ভান করেই সিরিয়াসলি হয়ে বলে রুদ্র তোমার বিকাশ নম্বরটি দেও। রুদ্রর উওর নেই। হ্যালো, হ্যালো রুদ্র তোমার বিকাশ নম্বরটি দেও। আমি সব জেনেছি। রুদ্রর বোঝার বাঁকি রইল না। সেই মেয়েটি। সেই মেয়েটি শিউলী সে ওকে পাগলের মতো ভালবাসতো। কিন্তু রুদ্রর বাবা ওদের বাসায় কাজ করতো বলে রুদ্রর মা তার সাথে সর্ম্পক করতে নিষেধ করে স্কুল লাইফেই তারপর এখানেই সর্ম্পকটা থেমে যায়। হয়তো এক সঙ্গে নেই ওরা। কিন্তু ভালবাসাটা বোধ হয় এখনো আছে শিউলীর।
শিউলী বলেছিল আমার কাছে তো টাকা নেই রুদ্র তবে দেখি কোন একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। শিউলীর বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা ও আছে একটা সুখী পরিবার। রুদ্রকে পেলে হয়তো পূর্নতা পেত।

গল্পে ফিরে আসি, রুদ্র কিছু প্রশ্ন করে নি। বলে উঠে, রুদ্র বলে উঠে অনেক অনেক টাকা লাগবে পারবেন দিতে? আকতার চাচা জানতে চায়, কত? কতো রুদ্র? রুদ্র চেয়ে বসে ২০ হাজার টাকা। আকতার রাজি হয়ে যায় দু,বারে রুদ্রর পার্সোনাল বিকাশ নম্বরে পৌঁছে যায় ১০ হাজার, ১০ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা। বাড়িতে আসার সময় এখন চেনা পথটা কেমন জানি লাগছে রুদ্রের, অর্ধেক রাস্তাটা অনেক বেশি দূরত্বের মনে হয় তার কাছে, কুয়াশাই ৪ পা সামনে ও দেখা যাচ্ছে না। ভেসে আসছে শিয়ালের সেই করুন আওয়াজ যেন ওরাই বিপদে পড়েছে। রুদ্র প্রানপনে দৌড় দেয় এক ঝাপটায় দরজা খুলে মুখে ছলবল হাসি নিয়ে বলে ওঠে মা। মা! মার উওর নেই। ছোট বোনটা ঘুমিয়ে পড়েছে মা কে জড়িয়ে। এবার অনেক ডাকাডাকি, ঝাঁকুনি দিয়েও লাভ হলো না। নাকের কাছে হাত দিয়ে রুদ্র দেখে নি:শ্বাস পড়েছে না! রুদ্র জানে আমার আর্তনাদ ছোট বোনটা হয়তো কষ্টে ঝলসে যাবে। না পারছে কাঁদতে! না পারছে সহ্য করতে বোনকে কোলে নিয়ে মা কে বিছানায় শুয়ে, হ্যারিকেনের আলোয় সারারাত এক দৃষ্টিতে মা’র দিকে চেয়ে থাকে রুদ্র। পরদিন আত্নীয়রা জিজ্ঞেস করছে কি ভাবে মারা গেল? রুদ্রর কোন উওর নেই।

কারন ও জানে কেমন করে বেঁচে ছিল এটা কেউ কোনদিন প্রশ্ন করেনি। শেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করে ছোট বোনটাকে সাথে নিয়ে রুদ্র ঢাকার উদ্দ্যেশে রওনা দেয়। মোবাইলটা সিম সমেত কাশেম চাচার কাছে বিক্রি করে। বাঁকি পরিশোধ ছাড়াও কাশেম চাচা ঢাকায় ফিরার টাকা দেয় রুদ্রকে। রুদ্রর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, কান্না করে বুকে জড়িয়ে ধন্যবাদ জানায় সে কাশেম চাচাকে। কিছুদিন পর নোলক ঢাকায় আসে। ও ঢাকায় ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। একদিন দেখা হয় নোলকের সাথে, অনেক কথা হয়, তারপর মাঝে মধ্যেই দেখা হতো। রুদ্র সবে খারাপ সময়টা কাটিয়ে উঠেছে। তবে ছোট বোনটাকে অভাবের তাড়নায় এখনো স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। ও বাসায় থাকে। পাগলীটা অনেক ভালবাসে রুদ্রকে! কি অভিমানী! চালাক! আমি খেয়েছি তুমি খেয়ে নেও! আতœা তৃপ্তির এই মিথ্যা কথা গুলো বলে ভাইকে খাইয়ে দেয় পিচ্ছিটা! একদম মায়ের মতো হয়েছে। রুদ্রর কাছে তার ছোট্র পাগলিটা এখন একমাত্র কলিজার টুকরা! আর মিম মনির কাছে রুদ্র তার মা-বাবা, ভাই- বোন, বন্ধু, প্রেমিক, অভিভাবক কিংবা সুপারম্যান সবকিছু! অনেক কষ্ট করে আর ম্যানেজারকে বুঝিয়ে রুদ্র একটা মোবাইল ফোন কিনে। মাঝে মধ্যে বাড়তি টাকাও যায় এখন নোলকের পিছনে। নোলক তার মা-বাবা নেই এতটুক জেনেছিল! এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একটি গ্রুপ অফ কোম্পানীর মালিকের ছেলে পছন্দ করে ফেলে নোলককে। নোলককে বাসায় চলে যেতে হয় বাবার জরুরী আহ্বানে। বাসায় ফিরতে কাসেম চাচার দোকানে যায় নোলক ছোট ভাইয়ের জন্য পটেটো চিপস নিতে তখন কাশেম চাচা চায়ের ক্যাটলি থেকে চা দিচ্ছে আর রুদ্রর কাহীনি বলছে। নোলক কাছে যেতেই ভেসে আসে কানে একটাই ছেলে দেখেছি জীবনে রুদ্র! রুদ্র!

পরদিন একান্তে সবকিছু কাশেম চাচার কাছে শোনে নোলক। ও সবকিছু জানতে পেরে যায়। নোলকের এমন মনে হচ্ছে রুদ্র যদি তার বুক চিরে কলিজাটা ছিঁড়ে বের করে নিয়ে যায় তবুও ভালবাসতে ইচ্ছে করবে রুদ্রকে। নোলকই পাগলী হয়ে যায় রুদ্রর জন্য ও পালিয়ে আসে রুদ্রর কাছে। এখান থেকে ওরা পালিয়ে যায় অনেক দূর বহুূর! এখন অবশ্য ঠিকঠাক। সবকিছু ঠিকঠাক। রুদ্র ভালো একটা চাকুরী শুরু করেছে। মিম মনি এখন স্কুলে যায়, নোলক ও পড়ছে। ওরা বিয়ে করেছে। রুদ্র তার ভার্সিটিতে এসে কখনো বন্ধুদের সাথে জীবন কাহিনী শেয়ার করেনি। তারা চিনতো এক কিপ্টে রুদ্রকে। যে কখনো পার্টিতে জয়েন্ট করেনি, বোন ভোজনে অংশ নেয়নি। তবে একবার বাধ্যতামূলক শিক্ষা সফরে নিয়ে তো বেশ একটা কাহিনীই করে ফেলেছিল সে। রুদ্রকে প্রায় দেখা যেত আবিরের রুমে এসে দাঁত ব্রাশের পেস্ট নিয়ে যেতে আবার কয়েকদিন পরপর নাবিলদের রুমে এসে সকালে ডাকাডাকি করতো পেস্ট নেবার জন্য। রনিদের রুমেও যেত। আজ এর রুমে কাল ওর রুমে। মনে হয় এক রকম রুটিন করে হোস্টেলের সকলের রুমে ও পেস্ট আনতে যেত। ঠিক এ বিষয়টা যেমন জানাজানি হয়েছিল তখন। এখন জানাজানি হয়েছে তার লাইফ স্টোরি। ওরা এখন খুজে রুদ্রকে। পেয়েছেও! কিন্তুু রুদ্রর উপর সেই বিরক্তিবোধটা আর নেই। শতগুনে মায়া মহব্বত ভালবাসা আফসোস জন্মেছে। ওদের উদাহরণ এখন রুদ্র! একটা ছেলে দেখেছি জীবনে রুদ্র! রুদ্র! জীবনে অন্তত একটি মাত্র ভালো মানুষের ছায়া পেলেই আর ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম থাকলেই ভবিষ্যৎ আলোকিত করা সম্ভব। যার উদাহরণ রুদ্র! আর সে ভালো মানুষটি হলো আকতার চাচা।

রুদ্র এখন আর বোনকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা নেই। একসময় ছোট বোনটার বিয়ে নিয়ে ভাবতো রুদ্র। আর এখন….ওর এখন স্বপ্ন মিমকে অনেক বড় হতে হবে, অনেক বড়, আমার চেয়ে বড়। তাই তাকে পড়াশুনা করাবে রুদ্র। নোলক আর মিম যেন আত্নার আত্নীয়, বান্ধবী, দুই বোন। ওদের ভালো থাকাটাই রুদ্রর ঠোঁটের কোনে ভাঁজ এনে দেয়।

এসব খবর কিন্তু তার বড় ভাই বা গ্রামের মানুষ কিছুই জানে না। গত ঈদে নোলককে সাথে করে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল রুদ্র। ২ রাত থেকেই চলে আসতে হয়েছিল। ছুটি শেষ? না ,না এবার আর ছুটি শেষ না। রুদ্রর ভাবির কথা; এ বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে গিয়েছিলে বাপু! ভিঁটেমাটি ত্যাগ করে এ বাড়ি আর তোমার নেই। কিছুই বলেনি রুদ্র। রাগে, ক্ষোভে, তিক্ততায়, মা-বাবার কবর যিয়ারত করে পরদিন সকালেই রওনা দেয়। যাবার সময় পিছন পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল মিম! ওকে ধমক দেয় রুদ্র! আবার নিজেই কেঁদে দেয়, আবার নিজেও তাকায়। দুজনে তাকায়! এখানেই যে ওদের মা-বাবা ঘুমিয়ে আছে! ওদের নীড় পোতা আছে। মানতে পারছেনা, অসহ্য যন্ত্রনা। তারপরও যেতে হবে, হ্যাঁ যেতে হবে মিমের হাত হঠাৎ শক্ত করে ধরে জোরে হাঁটা শুরু করে রুদ্র। হয়তো আর কোনদিন ফিরা হবে না, বা হলেও সেটা কেবল মা-বাবার কবরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আমাদের আশেপাশে এই সেই আক্তার চাচার মতো এমন অনেক আক্তার চাচা আছে। আক্তার চাচাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। যুগে যুগে বেঁচে থাক আক্তার চাচারা। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক রুদ্র আছে যার জীবন কাহীনি সম্পূর্ন না মিললেও অনেকটাই মিলে যায়। রুদ্ররা এগিয়ে যাক, এরা জয়লাভ করুক, রুদ্ররা ভাল থাক। এমটাই প্রত্যাশা।