জিরো পয়েন্টে কাঁদছে ২০ হাজার রোহিঙ্গা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর তাণ্ডব কোনোভাবেই থামছে না। প্রতিদিন রুটিনমাফিক নিপীড়ন চালানো হচ্ছে একের পর এক গ্রামে।

জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘর-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান। পাখি শিকারের মতোই গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে আশ্রয় নিয়েছে ২০ হাজার রোহিঙ্গা।

রাখাইনের আকাশে আসা হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছে বোমা। ফলে সীমান্তে বেড়েছে অসহায় নারী-শিশু ও বৃদ্ধের উপস্থিতি। মঙ্গলবার সকালেও কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থান দিয়ে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত দিয়ে আসা ঢেকিবনিয়ার আহমদ কবির জানান, সোমবার সেনাবাহিনীর একটি দল পাড়ায় এসে বেশ কিছু মানুষকে ধরে। চোখের সামনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়িসহ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাতের আঁধারে তাদের বাঁধন থেকে আমরা কয়েকজন পালিয়ে সীমান্তে চলে এসেছি।

উখিয়ার বালুখালী টিভি রিলে কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকায় চার রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। এরা টেকনাফ উপজেলার উলুবোনিয়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মঙ্গলবার ভোরে এদেশে প্রবেশ করে। চাঁন্দের গাড়িতে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।

এদেরই একজন রাখাইন রাজ্যের শীলখালী গ্রামের মৃত আবদুল মজিদের স্ত্রী রফিজা খাতুন (৫০)। তিনি বলেন, এত দিন পাশের গ্রামে আগুন দেয়া হলেও সোমবার সন্ধ্যায় আমাদের গ্রামে আসে নির্যাতনকারীরা। চলে আগুন লাগানোর খেলা। সব পুড়ে ছাই হচ্ছে দেখে কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি।

একই গ্রামের আবিদা খাতুন বলেন, আমার চোখের সামনে স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে মিলেটারি বাহিনী। আমার তিন সন্তান নিয়ে কোনো রকম পালিয়ে এসেছি।

তাদের মতে, এলাকায় ফিরে যাওয়া হবে কিনা জানি না। এতোদিনে বসতি তছনছ করে দিয়েছে তারা। জমি-জমা ফেলে চলে আসতে মন ব্যাকুল করেছে। হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে বোমা ফেলছে। এভাবে হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাদের আবাস চিহ্ন।

রাখাইনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ উল্লেখ করে ঢেঁকিবোনিয়া মিয়ারপাড়ার কামরুল ইসলাম বলেন, রাখাইনে যে অবস্থা কী করব ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রিত থেকে কীভাবে দিন কাটাব।

সীমান্তে পালিয়ে আসা মোস্তাক আহমদ বলেন, আমার ছয় ছেলের তিনজনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এক নাতিকে চোখের সামনে গলাকেটে হত্যা করেছে তারা। এতে দিশেহারা হয়ে আরেক নাতির সহায়তায় এখানে (জিরো পয়েন্টে) আসি।

তিনি আরও বলেন, আশির দশকে মিয়ানমার জান্তা সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন দেখেছি। নব্বই দশকের বর্বরতাও দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো এত ভয়াবহ বর্বরতা আগে কখনও দেখিনি।

সীমান্তে অবস্থানকারীদের অভিমত, নাগরিকত্ব হিসেবে না মানুক, মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারটা তো দিতে হবে। এ বর্বরতা কেন? কেন যুবাদের ধরে নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে?

এদিকে, ঘুমধুম রেজু মৌজার চিকনছড়া, মনজয়পাড়া, ফাত্রাঝিরি, লাকড়িছড়া বাজার দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ অনুপ্রবেশ করছে। দিনের বেলায় বিজিবি তাড়া খেয়ে তারা পাহাড়ের দিকে চলে গেলেও রাতের আঁধারে ঢুকছে। জিরো পয়েন্টে খাবার ও পানীয় সঙ্কটের কারণে তারা বাধ্য হয়ে এদেশে ঢুকে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ক্যাম্প ও বাসাবাড়িতে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা।

সীমান্তের অধিবাসী ইউছুফ ও আবু শামা, আবুল কালাম বলেন, ওয়ালিদং, মগ পাহাড়, গাছবনিয়া, গর্জনবনিয়া, বড় খালের আগা হয়ে সোমবার ২-৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নদীপথে অনুপ্রবেশ কালে বিজিবি আটকায়। তাদের ধাওয়া করলে তারা পাহাড়ের দিকে ফেরত যায়।

কুতুপালং গ্রামের সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন ডব্লিউএফপি ও ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় টমটম ও সিএনজিযোগে রেজু আমতলী থেকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। অনেকে আহত হয়ে এমএসএফ হল্যান্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছে।

সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকাশে কিছুক্ষণ পর পর একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে পুনরায় মংডু শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। রাখাইনে সহিংসতার পর থেকেই এভাবে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা যায়। আর হেলিকপ্টার চক্কর দেয়ার পর পরই গোলাগুলি ও রোহিঙ্গাদের সীমান্তে পালিয়ে আসা বাড়ে।

মঙ্গলবার দুপুরে ঘুমধুন সীমান্তের কাছাকাছি সেদেশের ক্যাম্পে ল্যান্ড করছে ওই হেলিকপ্টারটি। পরে হেলিকপ্টারটি চক্কর দেয়ার পরপরই সীমান্তের কাছাকাছি রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। শোনা যায় বিকট শব্দের গুলি ও মর্টারশেলের আওয়াজ।

ঘুমুধুম ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মঙ্গলবারও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। তাই সীমান্তে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাড়ছে।

বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম বলেন, মঙ্গলবারও রাখাইনের আকাশে সেনাদের একটি হেলিকপ্টার দেখা গেছে। এটি অবস্থান করে চলে যাবার পর তাণ্ডবের বেশ কিছু আওয়াজ সীমান্তের এপারেও এসেছে। আতঙ্কে তাই রোহিঙ্গাদের সীমান্তে আসা কমেনি। তবে অনুপ্রবেশ রোধে কড়া নজরদারি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।