টাঙ্গাইলে যৌনপল্লীর শিশুরা পেয়েছে ‘আলোর পথ’

টাঙ্গাইলের যৌনপল্লীর শিশু শান্ত। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সে। আকাশে উড়তে তার ভালো লাগে। তাই সে পাইলট হতে চায়।তার সহপাঠী মোহাম্মদ আসিফ। তার ভালো লাগে বিল্ডিং বানাতে। তাই সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়।দীপা আক্তার পায়েল। সে দশম শ্রেণির ছাত্রী। ইয়ার হোস্টেস হয়ে নানা দেশ ঘুরে বেড়াতে চায় সে।

এরকম ৫ম শ্রেণির ছাত্র রিপন মিয়া, ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ফাতেমা আক্তার বৈশাখী, ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ঝর্ণা আক্তার। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা স্বপ্ন। বড় হয়ে তারা দেশের জন্য কাজ করতে চায়। সোনার বাংলাদেশে ওরা সোনার মানুষ হতে চায়।

ওরা সবাই সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের শিক্ষার্থী। টাঙ্গাইলের সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস-এসএসএস এ হোমটি পরিচালনা করছে।

টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশুরা যখন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন এসএসএস তাদের তুলে আশ্রয় দেয় সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমে। এখানে থাকা, খাওয়া, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনসহ শিশুদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য নানা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এমন কি বিয়ের ব্যবস্থাও এখান থেকে করা হয়।

এই হোমের অধীনে বর্তমানে যৌন পল্লীর মেয়েদের প্রায় ৮৫ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ছেলে ৩৯ জন ও মেয়ে ৪৬ জন।

এ ব্যাপারে সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের অধ্যক্ষ আব্দুল হক বলেন, বর্তমানে হোমে শিশুর সংখ্যা ৮৫ জন। শিশুদের জন্য হোমের ভেতরে মৎস্য খামার, ডেইরি ফার্ম, ফলের বাগান, কৃষি খামার করা হয়েছে। শিশুদের খেলাধুলার জন্য মাঠ, নাচ-গান, চিত্রাঙ্কন শেখার ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে।

তিনি বলেন, হোমের ভেতরে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করে বাইরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এখানকার শিক্ষার্থীরা।

শুরুর দিকে তাদের কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। নানা বাধা তাদের আক্রমণ করেছে। এসএসএস’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের জন্মকথা জানান, ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে প্রথম অবস্থায় তারা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতেন। শিশুদের এনে তারা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। কিছুদিনের মধ্যে দেখতে পান কেউ কেউ চলে যাচ্ছে কারণ টাঙ্গাইল শহরের যৌনপল্লীর শিশুদের সঙ্গে অন্য শিশুরা মিশতে রাজি না হয়ে চলে যাচ্ছে। তখন যৌনপল্লীর শিশুদের নিয়ে কাজ করার বিষয়টি তাদের পরিকল্পনায় আসে।

তিনি জানানা, যৌনপল্লীর পাশেই খোলা জায়গায় শিশুদের নিয়ে লেখাপড়া শুরু করা হয়। পরবর্তীতে শহরের কোদালিয়ায় একটি বাসা ভাড়া করে ৪০ জন শিশু নিয়ে ‘শাহানা সেফ হোম’ নামে তারা কাজ শুরু করেন। তাদের উদ্দেশ্য, যৌনপল্লীর অন্ধকার জীবন থেকে এই শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে আলোর পথে নিয়ে আসা। কিন্তু যৌনকর্মীদের সন্তান হিসেবে অনেকে ভৎসনা করতে শুরু করেন। স্থানীয়দের বিভিন্ন চাপও সেগুলো মোকাবেলা আসে সফলতা।

তিনি জানান, এক পর্যায় নেদারল্যান্ডের এক ডোনার অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন। তারপর কোদালিয়া থেকে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কুইচবাড়িতে বিশাল জায়গা নিয়ে সোনার বাংলা চিলড্রেন হোম নামে এর কার্যক্রম চালু হয়। সেখানেও অনেক বাধা আসলে তা কাটিয়ে উঠে এলাকার মানুষের সমর্থন নিয়ে এর কার্যক্রম এখন গতিশীল রয়েছে।

আব্দুল হামিদ ভুইয়া বলেন, বর্তমানে যৌনপল্লীর শিশুদের কোন পরিচয় নেই। সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের মাধ্যমে ওই শিশুরা সে সুযোগ পাচ্ছে। এই শিশুদের মধ্যে রয়েছে অনেক প্রতিভা। এছাড়া মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মার্শাল আর্ট শেখানো হয়। এখান থেকে মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় করার জন্য অনেকেই বিদেশেও গিয়েছিল। সেখানেও তাদের সফলনা এসেছে।

তিনি বলেন, যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশুরা যাতে পূর্বসূরিদের পথে না যায়, তারা যেন এই সমাজের অন্য শিশুদের মতো সুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং সামাজিক মর্যাদা পায় সেজন্য এসএসএস সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। হোমের শিশুরা এখন আঁধার পেরিয়ে আলোর যাত্রী।

এ ব্যাপারে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মো. শান্ত বলে, এখানে থাকতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।

সে বলে, ‘আমার খুব ইচ্ছা আকাশে উড়ে বেড়ানোর। আমি জানি, পাইলট হলে বিমান নিয়ে আকাশে ওড়া যাবে। তাই আমি বড় হয়ে পাইলট হতে চাই।’

এ বিষয়ে যৌনকর্মীদের সংগঠন নারীমুক্তি সংঘের নির্বাহী সভাপতি আকলিমা আক্তার আঁখি বলেন, ওই সংগঠনটি আমাদের অনেক ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করানোসহ অনেক দিক দিয়ে সহযোগিতা করছে। এমনকি তাদের নিজস্ব অর্থায়নে ইতোমধ্যে কয়েকজন মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছে। তাদের এ ধরনের উদ্যোগ আমরা স্বাগত জানাই।

তিনি বলেন, আমাদের যাতে সরবকারিভাবে বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তবে আমরা বর্তমানে খুব কষ্টে এবং আতঙ্কে দিন যাপন করছি বলে তিনি জানান।