ঢাকার দুই মেয়রকে লাল কার্ড

মশা মারায় ব্যর্থতার অভিযোগে দুই মেয়রকে লাল কার্ড দেখানোর কর্মসূচী পালন করেছে লেখক-শিল্পী-ছাত্র-শিক্ষক ও ঢাকার নাগরিকরা। শনিবার বিকেলে শাহবাগে এই কর্মসূচী পালন করেন তারা।

টানা ১০ মিনিট চলে এই লাল কার্ড প্রদর্শন কর্মসূচি। ফুটবল মাঠে খেলোয়ারের মারাত্মক ‘ফাউল’ এর জন্য শাস্তি হিসেবে রেফারি লাল কার্ড দেখান। ঠিক তেমনি দায়িত্ব পালনে দুই মেয়র চরম ব্যর্থ এই অভিযোগে শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে লাল কার্ড দেখানোর কর্মসূচি পালন করা হয়। এরপর প্রয়োজনে মেয়রদের অফিসের সামনে গিয়ে লাল কার্ড দেখানোর হুঁশিয়ারি দেন বক্তারা।

কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা মশা মারতে দুই মেয়রের গাফিলতির অভিযোগ তুলে ঢাকা মহানগর উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। মেয়র আনিসুল হকের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বক্তারা বলেন, আপনাকে ঘরে ঘরে মশারি টানাতে হবে না, ঢাকা শহরের মশা দূর করুন।

কলামিস্ট লীনা পারভীন বলেন,চিকুনগুনিয়া ছড়ানো এডিস মশা কামড়ায়, ওই সময়ে কেউ মশারি টাঙিয়ে ঘুমায় না, কর্মস্থলে যায়। তাহলে কী আমাদেরকে মশারি পরেই বাইরে বের হতে বলছেন?’

এসময় বক্তারা আরো বলেন, আপনাদের ভোট দিয়ে এনেছি, এখন আপনাদের লাল কার্ড দেখাতে হচ্ছে। এখন মশা মারার দাবি নিয়ে নাগরিকদেরই রাজপথে দাঁড়াতে হচ্ছে।

প্রকাশক রবীন আহসান ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের চিকুনগুনিয়া নিয়ে দেয়া বক্তব্যের সমালোচনায় বলেন,“বাড়ি বাড়ি ঢুকে মশারি টানাতে হবে না। আপনারা জলাবদ্ধতা দূর করেন। বছর জুড়ে খোড়াখুড়ির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুন। জলাশয় ভরাট করে বৃষ্টির পানি গড়ানোর জায়গায় গড়ে তোলা বহুতল ব্যবসায়িক ভবন সরান। চিকুনগুনিয়া যখন পুরো ঢাকা শহরকে পঙ্গু করে রেখেছে তখনই আবার বৃষ্টিপাতে অর্ধেক ঢাকা যেনো নদী হয়ে গেছে। অথচ হেসে হেসে বলছেন ‘আমরা কী করবো’।”

নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন,‘চিকুনগুনিয়ার ভুক্তভোগীদের স্বাভাবিক জীবন এখন বিপর্যস্থ। অথচ এই রোগ ছড়ানো মশা দমন করা যাদের দায়িত্ব ছিলো তারা সেটা পালন করেনি। ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন এবার থেকে নাকি ‘সমাধান যাত্রা’ শুরু করবেন। কিন্তু গতকাল তিনি নাগরিকদের ওপরই আক্রোশ ঝেরেছেন,আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। দক্ষিণের মেয়রও দোষ চাপিয়েছেন নাগরিকের ওপর।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আগামী ৩ দিনের মধ্যে চিকুনগুনিয়া মশা তাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এই বক্তব্যে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন,‘ আমরা জানি না কোন পথ বা পদ্ধতিতে ৩ দিনের মধ্যে চিকুনগুনিয়া ছড়ানো মশা তাড়ানো হবে। আমরা দেখছি সরকারের মন্ত্রী, সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের কারও বক্তব্যের সঙ্গে কারও বক্তব্যের মিল নেই। আপনারা মশা নিয়ে মশকরা করেন। আবার মতিঝিল, রাজারবাগের রাস্তায় নৌকা চললে নির্লজের মত বলেন জলাবদ্ধতা নেই জলজট আছে।’

মেয়ররা এভাবে দায় এড়াচ্ছেন অভিযোগ করে ক্ষোভ জানিয়ে অবিলম্বে নাগরিক সব ভোগান্তি দূর করার আহ্বান জানান বক্তারা। চিকুনগুনিয়াকে অবহেলায় মহামারী আকারে ছড়াতে দিলে নগরবাসী দুই মেয়রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবে বলেও হুঁশিয়ার করেন তারা।

নারী উন্নয়নকর্মী জাকিয়া শিশির বলেন, “মশা মারার মুরোদ নাই, এমন মেয়রের কাম (দরকার) নাই’ এ কথা যেন রাস্তায় নেমে বলতে না হয়।”

দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ স্বীকার না করে দুই মেয়র নাগরিকদের সঙ্গে তামাশা করছেন বলে অভিযোগ করেন কর্মসূচির অন্যতম আয়োজক আকরামুল হক।

ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন,’ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েও দায় এড়ানো চলতে থাকলে একসময় এই প্রতীকী লাল কার্ডের মত সত্যি সত্যিই নাগরিকরা আপনাদের মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।’

প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশে প্রথম উপস্থিতি জানান দেওয়া ভাইরাস জ্বর চিকুনগুনিয়া কেন চলতি বছর ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়লো, তার দায় নিতে রাজি নয় কেউ।

মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ার কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। এ রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ।

গত পাঁচ বছরে ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা মারতে ১১৬ কোটি টাকা খরচ করলেও ক্ষুদ্র ওই পতঙ্গের উপদ্রব না কমায় ভুক্তভোগীরা নগর কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের অঙুল তুলেছেন। এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও ঢাকায় চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য দুই সিটি করপোরেশনকেই দায়ী করেছেন।

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অভিযোগ মানতে রাজি নন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মশক নিধনে ব্যয় করেছে ৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর আওতায় প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং আর বিকেলে এডাল্টিসাইডিং করা হয় বলে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি।

মেয়র আনিসুল হক দাবি করেছেন, ড্রেনের মশা নয়, ঘরে জন্ম নেওয়া এডিস মশার কারণেই এ রোগ ছড়াচ্ছে, যেখানে পৌঁছানো সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়।

আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় ১৯৫২ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটার পর তা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এ রোগ দেখা দেয় ২০০৮ সালে, যার প্রকোপ চলতি বছর বর্ষা মওসুমের শুরু থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে।

ঢাকার ২৩টি এলাকাকে এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের রোগ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইইডিসিআর।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের কেন সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে না– তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছে।