ঢাকার ফুটবলে এমন দর্শক আছে এখনো!

দুদিন ধরেই আকাশের মুখ গোমড়া। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে থেমে থেমেই। খারাপ আবহাওয়া তো বটেই; সেই সঙ্গে হিমেল হাওয়া নিয়ে শীতের আগমনী বার্তা কর্মজীবী মানুষকে দ্রুতই ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। শরীরে চাদর চাপিয়ে ধোঁয়া ওড়া গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টেলিভিশনের রিমোট টেপা—এই আবহাওয়ায় এর চেয়ে আদর্শ বিনোদন আর কী হতে পারে। খেলাপ্রেমী মানুষ হলে টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টালেই তো আছে ইউরোপীয় ফুটবলের জমাটি লড়াই। কখনো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, কখনোবা স্প্যানিশ লিগ। মেসি-রোনালদো-নেইমাররা যে যুগে সবার বাড়ির বসার ঘরে ‘বাস’ করেন, সেখানে খেলা দেখতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে! তাও আবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ঢাকার নিত্য যানজট আর গণপরিবহন সংকটকে সঙ্গী করে!

গতকাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রায় দর্শকশূন্য নীরব-নিথর মাঠে চলছিল আবাহনী লিমিটেড ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের খেলা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইই। দেশের ফুটবলের ক্রান্তিলগ্নে এই ম্যাচ নিয়ে দর্শকেরা আবেগে উন্মাতাল হবে—এমন প্রত্যাশাও যেখানে প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে পূর্ব গ্যালারির দিকে বেশ অবাক হয়েই তাকাতে হলো। সেখানে দেখা গেল, বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে বেশ আয়োজন করেই এক দর্শক খেলা দেখছেন। কৌতূহলী হতেই হয়। এ যে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে চলা বিশেষ কেউ।

তাঁর নাম মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। ভূমি জরিপ রেকর্ড অফিসে কাজ করেন। ফুটবলটা মিশে আছে তাঁর অস্থিমজ্জার মধ্যেই। ঢাকার মাঠে নিয়মিত যাতায়াত সেই আশির দশকের জমজমাট দিনগুলো থেকেই। মোহামেডানের কড়া সমর্থক হলেও অন্য দলগুলোর খেলা দেখেন নিয়মিতই। মোহামেডান-সমর্থক বলেই পূর্ব গ্যালারিতে নিয়েছেন আশ্রয়। আবাহনীর পশ্চিম গ্যালারিতে কখনোই বসেন না। দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাবের লড়াই আকর্ষণ হারালেও এখনো অনেক মানুষ দুই ক্লাবের চিরন্তন রেষারেষিটা যে ধারণ করেন, সেটা আবু তৈয়বের বসার জায়গা থেকেই বুঝে নেওয়া যায়।

তেজগাঁওয়ের ভূমি জরিপ রেকর্ড অফিস থেকে বাস ধরে এসেছেন সোজা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। খুব সহজে যে আসতে পারেননি, সেটা বলাই বাহুল্য। এমনিতে বৃষ্টি-কাদায় পথঘাট সয়লাব, তার ওপর যানজট, যানবাহনের স্বল্পতা। কষ্ট করেই এসেছেন। তারপরও এই কষ্টটা স্বীকার করছেন, কারণ শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিসে গেলেও আগেভাগেই বেরোতে পেরেছেন। অন্য দিন বিকেল চারটার ম্যাচটা দেখতে পান না অফিসের কারণে।

আবু তৈয়বের ক্ষোভ শুক্রবার লিগের খেলা থাকে না বলেই, ‘সারা দুনিয়াতে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিনই লিগের খেলাগুলো ফেলা হয়। আমাদের এখানে তার ঠিক উল্টোটা। এ দেশে শুক্রবার খেলা থাকে না। লিগের খেলাগুলো সপ্তাহের ব্যস্ত দিনগুলোতে না ফেলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আর শুক্র-শনিবার ফেললে এমন খালি স্টেডিয়ামে লিগের খেলা আয়োজন করতে হতো না।’

ঢাকার ফুটবল এখন ভাঙা হাট। কিন্তু তারপরেও তৈয়বের মতো দর্শকেরা আছেন। এঁরা দেশের ফুটবলটা হৃদয়ে ধারণ করেন। স্বপ্ন দেখেন, ফুটবল একদিন তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ভরা যৌবনের দিনগুলোয়। সে জন্য বৃষ্টি-জল-কাদা পেরিয়ে, জীবনের অন্য সুখগুলোকে বিসর্জন দিয়ে তাঁদের মাঠে আসা।

এঁদের জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছে আমাদের ফুটবল ফেডারেশন?