ঢাবি ভিসিকে ছাত্রলীগের ‘উদ্ধার’, বিক্ষোভকারীদের পিটুনি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) নিপীড়নবিরোধী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অবরোধ করে রাখা উপাচার্য আখতারুজ্জামানের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তার আগেই উপাচার্যকে ঘুষি দেন এক বিক্ষোভকারী।

উপাচার্যকে উদ্ধারে আসা ছাত্রলীগের সঙ্গে এক দফায় বিক্ষোভকারীদের হাতাহাতি হয়। পরে রড নিয়ে এসে পিটুনি দেয়া হয় বিক্ষোভকারীদের অন্তত তিনজনকে। কিছুক্ষণ পর পেটানো হয় ব্যাপকভাবে।

বিভিন্ন দাবিতে মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১২টা থেকে বিকাল সোয়া তিনটা পর্যন্ত উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তাকে অবরোধ করে রাখে আন্দোলনকারীরা। আর ঘণ্টা তিনেক পর সেখানে আসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

গত ১৫ জুলাই সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের চড়াও হওয়া এবং সেদিন মেয়েদের প্রতি কটূক্তি ও ‘যৌন হয়রানি’র ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের দাবি করে আসছে বিক্ষোভকারীরা।

নিপীড়নবিরোধী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই আন্দোলনে মূলত বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।

আজকের এই কর্মসূচিতে ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. ফয়েজ, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি তুহিন কান্তি দাশ, বাম নেত্রী উম্মে হাবিবা বেনজীর এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কয়েকজন নেতা নেতৃত্ব দেন।

তারা উপাচার্যকে তার কক্ষের বাইরে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলার দাবি জানচ্ছিলনে। কিন্তু উপাচার্য তার কক্ষের ভেতরে অবস্থান করছিলেন।

১১টার দিকে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হন শ দুয়েক শিক্ষার্থী। পরে তারা উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে যান। কিন্তু কার্যালয়ের কর্মীরা ভেতর থেকে লোহার ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা ফটকে ধাক্কা দিতে থাকেন। একপর্যায়ে সেটি ভেঙে যায়। এরপর ভেতরে ঢুকে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন তারা।

সিনেট ভবনে অ্যাকাডেমিক মিটিংয়ে যোগ দিতে উপাচার্য বেলা তিনটা ১০ মিনিটে বের হন তার কক্ষ থেকে। এরপর তাকে, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী এবং শিক্ষক সমিতির নেতাদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভকারীরা। তারা ‘যৌন নিপীড়নে’ জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের তখনই বহিষ্কারের দাবি জানাতে থাকেন।

এ সময় হ্যান্ডমাইকে একজন বলতে থাকেন, ‘আপনাকে এই মুহূর্তে ছাত্রলীগের কর্মীদের বহিষ্কার করতে হবে এবং প্রক্টরকে পদত্যাগ করাতে হবে। অন্যথায় আমরা আপনাকে ছাড়ব না। কোনো অ্যাকাডেমিক মিটিং হবে না।’

উপাচার্য এ সময় বলেন, ‘তদন্ত কমিটি হয়েছে, এর প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এর জন্য সময় লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। সময়ের প্রয়োজন। আমাদের আইন অনুসারে সব করতে হবে।’

এ সময় বিক্ষোভকারীরা সমস্বরে সবাই ‘না’ বলে চিৎকার করে বলেন, ‘আইনের অজুহাত মানব না। যা করার এখনই করতে হবে।’

প্রায় আধা ঘণ্টা উপাচার্য এভাবেই আটকা পড়েন বিক্ষোভকারীদের মাঝখানে। একপর্যায়ে উপাচার্যকে ঘুষি মারেন তানভীর আহমেদ মুঈন নামের এক বিক্ষোভকারী। তিনি একটি বামসংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

এই পরিস্থিতিতে দৃশ্যপটে আসে ছাত্রলীগ। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে কয়েক শ নেতা-কর্মী উপাচার্যকে বিক্ষোভকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যান।

এ সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতাহাতি হয়। তারা বিক্ষোভকারীদের হ্যান্ডমাইক আছড়ে ফেলে ভেঙে ফেলেন।

এরপর উপাচার্যের কক্ষের এক পাশে ছাত্রলীগ এবং অপর পাশে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয় স্লোগান দিতে থাকে। এর মধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির কিছু নেতা-কর্মী নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে তারা আবার ফিরে আসেন।

বেলা চারটার দিকে ছাত্রলীগের ১০ থকে ১৫ জন কর্মী রড হাতে উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে। তারা উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে রাখা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন। এতে দুজন মেয়ে এবং একজন ছেলে আহত হয়।

কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে আসা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একটি বড় মিছিল ঘটনাস্থলে আসে। এই মিছিলেরও নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির।

উপাচার্য কার্যালয়ের দুই দিকের দুই গেটে অবস্থান নেয় দুই পক্ষ। ছাত্রলীগের মিছিলে আছে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। আর বিক্ষোভকারীদের পক্ষে আছেন শ দেড়েক।

বেলা সাড়ে চারটার দিকে বিক্ষোভকারীদের তাড়া দিয়ে পেটানো শুরু করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ সময় বিক্ষোভকারীরা নিরাপদ জায়গায় যেতে ছুটতে থাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহাজাদা বলেন, ‘আমরা এইখানে ছাত্রলীগ হিসেবে আসিনি। আমরা এসেছি সাথারণ ছাত্র হিসেবে। কারণ রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা ছাত্র। আমরা গিয়েছিলাম আমাদের অভিভাবক উপাচার্য স্যারকে উদ্ধার করতে। কাউকে আক্রমণের উদ্দেশ্য নয়।’

যেসব দাবিতে বিক্ষোভ

গত ১৫ জানুয়ারি সাত সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। তবে সে আন্দোলন এখন চার দফায় গড়িয়েছে।

উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ওই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ আছে। একই কর্মসূচিতে থাকা মেয়েদেরকে সেদিন কটূক্তি ও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।

আর এরপর থেকে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের দাবি যোগ হয়। এই দাবিতে ১৭ জানুয়ারি শিক্ষা্থীরা প্রক্টর কার্যালয় ঘেরাও করতে যায়। কিন্তু ভেতর থেকে তালাবদ্ধ করে রাখার পর ওই ফটক ভেঙে ফেলে শিক্ষার্থীরা।

এই ঘটনায় আবার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের কারও নাম উল্লেখ না করে ৫০ থেকৈ ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় শাহবাগ থানায়। প্রক্টর কার্যালয়ের ফটক ভাঙচুরের ভিডিও ও স্থিরচিত্রও দেয়া হয়।

ওই রাত থেকেই আবার নতুন দাবি যোগ হয় শিক্ষা্র্থীদের। মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিও জানাতে থাকে তারা।

আর আন্দোলনের মুখে যৌন হয়রানির তদন্তে বৃহস্পতিবার কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন উপাচার্য।

শিক্ষার্থীরা এই ব্যবস্থা নিতে রবিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না দেখে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করা হয়।

সাত কলেজ নিয়ে অবস্থান পরিস্কার করেছে ঢাবি

সেই সাত কলেজের সংকট সমাধানের দাবিও তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।

অবশ্য সাত কলেজের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অপরিকল্পিত ছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রমকে কোনোভাবেই ব্যাহত করবে না।

গত ২০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিচয়পত্র দেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, পাঠাগার প্রভৃতির কোনোটিই ব্যবহার করার সুযোগ তাদের নেই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রধারী শিক্ষার্থীদের জন্যই উন্মুক্ত। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়।