তানিয়া দশ বছরের ‘জিহাদি’ জীবন কেন ছেড়ে দিলেন?

তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের একজন আমেরিকান নেতার ব্রিটিশ সাবেক স্ত্রী বলেছেন চরমপন্থার পথ থেকে তিনি কীভাবে বেরিয়ে এলেন।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ তরুণী তানিয়া জর্জেলাসের আমেরিকান স্বামী জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের দুজনের পরিচয় হয়েছিল অনলাইনে।
ইসলাম মতাদর্শ নিয়ে তাদের মনের এবং মতের মিলের কারণে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

স্বামীর সঙ্গে তিনি চলে গিয়েছিলেন সিরিয়াতে। বছর দশেক ধরে তিনি ইসলামী চরমপন্থা অনুসরণ করেন।

“আমার স্বামী ইসলামিক স্টেটের শীর্ষস্থানীয় সদস্য ছিলেন। এখন আমি তার মতাদর্শের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”

১৯৯০ দশকের শেষদিকে তানিয়া উত্তর লন্ডনের হ্যারো এলাকায় একটি স্কুলে পড়তেন। মধ্যবিত্ত ওই এলাকায় নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের বাস।

বিবিসির এশিয়ান নেটওয়ার্কের প্রতিবেদক বলছেন তানিয়া ছিলেন আর পাঁচটা স্কুল কিশোরীর মতই। তার সেসময়ের বন্ধুরা বলেছেন তানিয়া ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না।
অথবা রাজনীতি নিয়েও তার কোন উৎসাহ ছিল না। কিন্তু সবকিছু বদলে গেল কখন এবং কেন?

“আমার যখন ১৭ বছর বয়স তখন আমি ধর্মের দিকে ঝুঁকি। আমি হ্যারোর তানিয়া হয়ে থাকতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম একটা নতুন পরিচয়। আমি চেয়েছিলাম ধার্মিক মানুষ হতে। আমি চাইনি লোকে ভাবুক আমি হালকা মেজাজের মেয়ে- সহজে যার সঙ্গে ফস্টিনস্টি করা যায়। ”

তিনি বলেন জন তাকে জীবনকে নতুন করে দেখতে শিখিয়েছিলেন।

“আমাকে সে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল- আমি অনুভব করতে শিখেছিলাম যে সমাজে আমার স্থান কোথায়। আমি কোন্ সম্প্রদায়ের- কোন্ সমাজের অংশ। ”

সেই সময় – বয়স যখন তার বিশের কোঠার গোড়ার দিকে তখন তানিয়া বেশ কিছু ইসলামী উগ্রপন্থী দলের সঙ্গে মেলামেশা করেছিলেন। তারা তার চিন্তাধারাকে বদলে দিয়েছিল। তারা তাকে বিশ্বকে ভিন্ন চোখে দেখতে শিখিয়েছিল।

“ওরা আমাদের অত্যাচার নির্যাতনের ভয়াবহ সব ছবি দেখাত। সেগুলো আমার মন জুড়ে থাকত, আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। যেমন ধরুন স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যার চিত্র। মনে হতো আমরা সবাই অপরাধী। অপরাধকে সমর্থন করছি। মনে হতো আমাদের সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের একটা কর্তব্য আছে। সেটাই ছিল জিহাদ। ”

তানিয়া তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি সেসময় আল কায়েদা, তালেবান বা যারাই মুসলমানদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিল তাদের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছেন।

লন্ডনে ৭ই জুলাই ২০০৫ এর জঙ্গী হামলায় মারা গিয়েছিল তারই স্কুলের সহপাঠী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত সাহারা ইসলাম। তানিয়া বলেছেন এত কম বয়সে তার বান্ধবীর অকালমৃত্যু তাকে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু তারপরেও তিনি ওই হামলাকে সমর্থন করেছিলেন।

“নিরীহ মুসলিম আর নিরীহ অ-মুসলিম- জিহাদের জন্য যে কারও মৃত্যুই সঙ্গত। এটাই পথ- তখন সেটাই সঠিক যুক্তি বলে মনে হতো,” বলেন তানিয়া।

তার স্বামী জন জর্জেলাসকে তার মনে হয়েছে “আকর্ষণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, প্রকৃত বন্ধু যার সঙ্গে চরমপন্থী মূল্যবোধ” তিনি শেয়ার করেছেন।

তানিয়া তখন চেয়েছিলেন তার সন্তানদের তিনি এমনভাবে বড় করবেন যাতে তারা মুজাহেদীন বাহিনীতে যোগদানের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। “খেলাফত আন্দোলনে এটাই আমার অবদান বলে আমি মনে করতাম। ”

২০১১ সালে আরব অভ্যূত্থানের পর জন ও তানিয়া বাচ্চাদের নিয়ে মিশরে যান। জন মনে করেছিলেন ছেলেদের জিহাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত করার জন্য মিশরই ছিল আসল জায়গা।

কিন্তু তানিয়া বলছেন সেসময়ই এই মতাদর্শকে সমর্থন করার ব্যাপারে তার মনে প্রথম সন্দেহ দেখা দেয়।

“একদিন আমার একটা ছেলে স্কুল থেকে ফিরে আমাকে একটা গ্রেনেড দেখাল। গ্রেনেডটা লাইভ ছিল না। কিন্তু আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে জনকে তাড়া করে গেলাম। বললাম আমার ছেলেদের হাতে বন্দুক আর গ্রেনেড আমি দেখতে চাইনা। তাদের ওসব জিনিসের ধারেকাছে দেখতে চাইনা। ”

২০১৩ সালে জন তার পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় যান। তানিয়ার গর্ভে তখন তাদের চতুর্থ সন্তান।

সিরিয়ায় তারা সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ভবনে থাকতে। “প্রতিরাতে গোলাগুলি আর যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে আমার বিবাহিত জীবন তখন ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ”

“জনকে আমি বলেছিলাম আমি ছেলেদের নিয়ে সিরিয়া থেকে চলে যেতে চাই। জন আপত্তি করে নি। বুলেট, চোরাগোপ্তা হামলা, গোলাগুলির মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া গলে শরণার্থীদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে আমাকে সাহায্য করেছিল জন। ”

তখন সিরিয়ায় আইএসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে শেষ পর্যায়ের লড়াই চলছে। তানিয়া বলেন জন বলেছিল তাকে শেষ অবধি লড়তে হবে। তিনি ফিরতে চান না।

“তার শেষ কথা ছিল আমার ও সন্তানদের প্রতি তিনি যা করেছেন তার জন্য তিনি দুঃখিত। ”

এক বছর পর্যন্ত জনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তানিয়া জানে না এরপর জনের কী হয়েছে। “হয়ত বা সে মারাই গেছে। ”

তানিয়া এখন থাকেন আমেরিকার টেক্সাসে। ২০১৫ সালে তিনি নতুন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন। তার নাম ক্রেগ। বাচ্চাদের অভিভাবকত্ব তিনি পাননি। জনের বাবা-মা তাদের মানুষ করছেন।

“বাচ্চারা আমেরিকায় নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তারা ভাল আছে। ”

“ইসলামের বাইরেও যে জানার অন্যান্য জগত আছে সেটাই আমি আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। আমার জীবনের মূল্যবান দশটা বছর আমি নষ্ট করেছি। ভুলপথে নিজেকে চালিত করেছি। আমি সংসার হারিয়েছি, সন্তানদের হারিয়েছি। তাই আমি চেষ্টা করছি যেন অন্য মেয়েরাও আমার মত ভুল না করে। আমার চিন্তার স্বাধীনতা আমি ফিরে পেয়েছি। ”

তানিয়া জর্জেলাস বলেন ‘জিহাদী’ না হয়েও ইসলামী মূল্যবোধকে যে সমুন্নত রাখা যায়, সে কথাটাই তিনি অন্যদের বোঝাতে কাজ করছেন।-বিবিসি