থামছে না ইয়াবা পাচার : চলছে নতুন রুটে, নতুন কৌশলে

বাংলাদেশ ইয়াবাবিরোধী অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণের পরও ইয়াবা পাচার থামছে না৷ বরং ইয়াবা পাচারে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে হেলিকপ্টারে করে ইয়াবা পাচারের চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল এ নিয়ে ছয়টি বেসরকারি হেলিকপ্টার সার্ভিসের মালিকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন৷ গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি৷ আর অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনের যাত্রীদের এই সন্দেহের বাইরে রাখা হয়নি৷ এজন্য নজরদারি ও নিরাপত্তা স্ক্যানিং আরো নিবিড় করতে বলা হয়েছে৷ বেসরকারি হেলিকপ্টার গুলোকে উড্ডয়নের ৬ ঘণ্টা আগে সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি নিতে হয়৷ দেখা গেছে তারা এই অনুমতি নেয়না৷ যাত্রীদেরও তেমন নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়না৷ এই দুটোই আইন অনুযায়ী কড়াকড়ি করতে বলা হয়েছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৩ এপ্রিল সংবাদমাধ্যমকে জানান যে হেলিকপ্টারে এবং উড়োজাহাজের যাত্রীদের মাধ্যমে মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের গোয়েন্দা তথ্য আছে৷ হেলিকপ্টারের যাত্রীদের যথাযথ স্ক্যানিং না করায় তারা এই সুযোগ নিচ্ছে৷

ইয়াবা পাচারের আরো কৌশল

এদিকে গত ২৯ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে ১৩ রোহিঙ্গার পেটের ভেতর থেকে ৪৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়৷ টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করা ২৩ রোহিঙ্গাসহ ২৬ জনকে ইয়াবাসহ আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর৷ এক্সরে করে এদের মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গার পেটে ইয়াবা নিশ্চিত হওয়া যায়৷ তাদের প্রত্যেকের পেটে ৩ হাজার পিসেরও বেশি ইয়াবা পাওয়া যায়৷

আর ৩ এপ্রিল দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ মর্গে এক নারীর লাশের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে দেড় হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়৷ ৪০ বছর বয়সি ওই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি৷ কে বা কারা হাসপাতালে তার লাশ রেখে যায়৷ একদিন আগে সন্ধ্যার দিকে দুজন লোক এই নারীকে হৃদরোগ ইস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান৷ কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করলে ওই দুজন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসার কথা বলে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি৷ ওই নারীর পেটে মোট ৫৭ প্যাকেট ইয়াবা পাওয়া যায়৷

এর আগে কক্সবাজারে মাছের পেটে করেও ইয়াবা পাচারের ঘটনা ঘটেছে৷ আর ডাব, কাঠাল, তরমুজসহ নানা ফলের মধ্যেও ইয়াবা পাচার হচ্ছে৷

থামছেনা ইয়াবা

শুক্রবার ভোর রাতেও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পৃথক অভিযানে ১ লাখ ৭০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা৷ ভোররাত চারটার দিকে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ফাইসাখালী ও টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মিনাবাজার মোরাপাড়া এলাকা থেকে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়৷ তবে কেউ আটক হয়নি৷

গত বছরের মে মাস থেকে বাংলাদেশে বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়৷ এপর্যন্ত এই অভিযানে শুধু কক্সবাজার এলাকায়ই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৬৩ জন নিহত হয়েছেন৷ এই পরিস্থিতিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে ১০২ জন মাদক পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেন৷ কিন্তু তারপরও থামছেনা ইয়ারা পাচার ও ইয়াবা কারবার৷

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই কক্সবাজারে ১১ লাখ ২০ হাজার ২৫১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে৷ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় ৩১৩ জনকে গ্রেপ্তার এবং ১৫৫টি মামলা করা হয়েছে৷ মার্চ মাসেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ মার্চে শুধু টেকনাফের সীমান্ত এলাকা থেকে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে বিজিবি৷

কেন থামছেনা ইয়াবা পাচার

কক্সবাজারের সাংবাদিক আব্দুল আজিজ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মাদকবিরোধী অভিযানে কোনো ইয়বা গডফাদার বা মূল ব্যবসায়ীদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ আর যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের মধ্যে গডফাদাররা নেই৷ তারা মূলত ক্যারিয়ার৷ ফলে ইয়াবার মূল ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে৷ তারা রাজনৈতিক বা অন্য কোনো পরিচয়ে বলতে গেলে প্রকাশ্যেই আছে৷ ফলে ক্যারিয়ার হিসেবে নতুন অনেক লোক যুক্ত হয়েছে৷ কৌশলে পরিবর্তন হয়েছে, রুট বদলেছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘নাফ নদী এবং সমুদ্রপথে ইয়াবা ঢুকছে কক্সবাজারে৷ আর এখন উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে ইয়াবা বহনে৷ ইয়াবা কারবার এবং পাচার একটুও কমেনি৷ আজকেও (শুক্রবার) কক্সবাজারে দেড়লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে৷”

কক্সবাজরের একটি স্থানীয় সূত্র জানায়, ‘‘মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাংশ এখন আর কক্সবাজারকে মধ্যবর্তী এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছেনা৷ তারা তাদের যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি ঢাকা বা উত্তরবঙ্গে ইয়াবা পাঠাচ্ছে৷ আর যারা প্রথমে কক্সবাজারে নিয়ে আসে তারা রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো ইয়াবা মজুদ রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে৷ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ মনে করে তাই এখন তাদের এই অবৈধ মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে৷”

রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে

কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডলের নেতৃত্বেই আটক ১৩ রোহিঙ্গার পেট থেকে ৪৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ওই ১৩ জন রোহিঙ্গা এর আগে কখনো বাংলাদেশে আসেননি৷ এবারই তারা প্রথম পেটের মধ্যে করে ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজারে আসে৷ তবে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে থাকা দুজন রোহিঙ্গাও ছিল৷ ছিল স্থানীয় লোক৷ ফলে এটা স্পষ্ট যে ওই ১৩ রোহিঙ্গাকে তারা ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে৷ মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দিয়ে এখন ব্যবসায়ীরা সরাসরি ইয়াবা পাচার করছে বাংলাদেশে৷”

তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে এখন ইয়াবা মজুদের কাজে লাগানো হচ্ছে৷ কিন্তু ক্যাম্পে অনেক লোকজন থাকে, সেনসেটিভ এরিয়া, তাই চাইলেই আমরা ক্যাম্পে অভিযান সবসময় চালাতে পারিনা৷ আর অনেক লোক থাকায় তারা টের পেয়ে যায়৷ তারপরও আমরা টেকনাফ নয়াপাড়া ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা নারীসহ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে ইয়রাবাসহ আটক করেছি৷”

সোমেন মন্ডল বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে দেশের অন্য এলাকায় ইয়াবা পাঠানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে৷ তারা ক্যাম্পে বসেই ইয়াবা পেটের ভেতর ঢুকায়৷ একজন দুই থেকে আড়াই হাজার পিস ইয়াবা পেটে ঢুকাতে পারে৷ তাদের আসলে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এর পেছনে এখানকার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আছে৷”

তিনি জানান, ‘‘আমরা যেসব রোহিঙ্গাদের আটক করি তাদের জিজ্ঞাসা করে মূল ব্যবসায়ীদের নাম জানতে পারিনা৷ আসলে ওরাও জানেনা৷ ওরা কাজ করে কোড বা সংকেতের ওপর৷”

হেলিকপ্টার ও বিমানে করে ইয়াবা পাচার প্রসঙ্গে সোমেন মন্ডল বলেন, ‘‘আমাদের কাছে হেলিকপ্টার ও বিমানে করে ইয়াবা পাচারের গোয়েন্দা তথ্য আছে৷ আমরা এর আগে কয়েকদফায় আটকও করেছি৷ তবে এটা যাত্রীরা যেখানে নামে সেখান থেকে ধরা সহজ৷ কারণ ইয়াবা তারা পেটে পরিবহণ করে৷ তাই নিশ্চিত না হয়ে আটক করা যায়না৷ আর নিশ্চিত হওয়ার পথ হল এক্স-রে করা৷ এখন আমরা যদি এখান (কক্সবাজার) থেকে আটক করি তারপর যদি এক্সরেতে না পাওয়া যায় তাহলে যাত্রীর টিকেট ও যাত্রা দু’টিই বাতিলের ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন তিনি৷”

চাহিদা কমেনি, চাই সামাজিক আন্দোলন

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করেছি৷ কিন্তু আরো অনেক বাইরে রয়ে গেছেন৷ অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী আছে যাদের মানুষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে জানেনা৷ ধরেন টেকনাফে ২ লাখ মানুষ তার মধ্যে ৮০ ভাগ কোনো না কোনোভাবে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত৷ এত বিপূল সংখ্যক লোককেতো আইনের আওতায় আনা কঠিন৷ আমরা দেখেছি অনেকেই জানতেন না যে এটা ইয়াবা৷ তারা মাল (পণ্য) নিয়ে আসতেন৷ মাল সরবরাহ করতেন, জানতেন না ইয়াবা৷ এখন তারা জানছেন৷”

তিনি বলেন, ‘‘যারা এখনো বাইরে আছে তারা কৌশল পরিবর্তন করছে, রুট পরিবর্তন করছে৷ আর নতুন লোকজনকে যুক্ত করছে৷ তারপরও ইয়াবা পাচার অনেক কমেছে, বন্ধ হয়নি সত্য৷”

এই পুলিশ কর্মকর্তার মতে, ‘‘এর আরেকটা দিক হচ্ছে চাহিদা৷ ইয়াবার চাহিদাতো কমেনি৷ সারাদেশেই আছে৷ ফলে ইয়াবা চোরাকারবারিরা তাদের ব্যবসার নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছে৷ এটা বন্ধ করতে হলে প্রয়াজন সামাজিক আন্দোলন৷ মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন দরকার, আমরা সেটাও গড়ে তোলার চেষ্টা করছি৷”