‘দাফনের রাজনীতি’ ভারতে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

ভারতে তামিল রাজনীতির অন্যতম লিজেন্ড এম করুণানিধিকে চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে তার রাজনৈতিক গুরু আন্নাদুরাইয়ের পাশেই সমাহিত করা যাবে বলে আদালত রায় দিয়েছে।

এর আগে তামিলনাডু সরকার মেরিনা বিচে তার মেমোরিয়াল গড়তে দিতে রাজি হয়নি, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করুণানিধির দল ডিএমকে আদালতে গেলে রাতভর শুনানির পর মাদ্রাজ হাইকোর্ট এদিন ডিএমকের পক্ষেই রায় দিয়েছে।

কিন্তু কেন মেরিনা বিচেই তার স্মৃতিসৌধ গড়তে এত মরিয়া ছিল করুণানিধির দল? মৃত্যুর পর কোথায় সমাধি তৈরি হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের জন্য সেটাই বা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আসলে ভারতে দ্রাবিড় রাজনীতির অন্যতম প্রধান আইকন, ৯৪ বছর বয়সী করুণানিধির মৃত্যুর পর গত সন্ধ্যা থেকে চেন্নাইতে যে রকম আবেগ আর নাটকীয়তার ঢল নেমেছে ভারতের রাজনীতিতেও তার তুলনা বিরল।

ওই রাজ্যে ক্ষমতায় আছে করুণানিধির প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এআইডিএমকে – সেই সরকার প্রথমে তাকে মেরিনা বিচে সমাহিত করার অনুমতি না-দিলেও কোর্টের নির্দেশে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে।

এর জন্য মাঝরাতেই বসেছিল মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ, সকালেই তারা তাদের রায় ঘোষণা করেছে।

ডিএমকে নেতারা বলছিলেন, “সরকারকে অনুরোধ করব আমাদের আবেগ নিয়ে খেলা না-করে তারা যেন আমাদের প্রিয় নেতা ড: কালাইনারকে মেরিনা বিচে আন্না মেমোরিয়ালেই সমাহিত করতে দেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না-করেন।”

তাদের যুক্তি ছিল, এর সঙ্গে তার কোটি কোটি অনুগামী, দলীয় ক্যাডার ও পরিবারের সদস্যদের আবেগ জড়িত।

করুণানিধি যেখানে শেষ শয্যায় শায়িত হোন বলে তার দল চাইছে, চেন্নাই শহরের কেন্দ্রে সাগর পাড়ের সেই মেরিনা বিচেই রাজ্যের তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাই, এমজি রামচন্দ্রন বা জয়ললিতার মেমোরিয়ালও রয়েছে পাশাপাশি।

বিবিসি তামিল বিভাগের সাংবাদিক কৃতিকা কানন বলছিলেন, সে রাজ্যের রাজনীতিতে ওই জায়গাটির গুরুত্ব কোথায়।

তার কথায়, “এই মেরিনা বিচেই ছিল একটি মঞ্চ, যেখানে থেকে তামিলনাডুর ইতিহাসে বহু স্মরণীয় রাজনৈতিক ভাষণ দেওয়া হয়েছে। পরে মঞ্চটি ভেঙে দেওয়া হলেও মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যুর পর ওই সমুদ্রতটেই তার স্মৃতিসৌধ তৈরি করেন তার উত্তরসূরি করুণানিধি।”

“পরে এমজিআর ও জয়ললিতার সমাধিও গড়া হয় তার পাশেই। এখন দ্রাবিড় রাজনীতিরাই সব দিকপালরাই যেহেতু সেখানে সমাহিত, তাই করুণানিধির ভক্তরাও সেখানেই তাঁর জন্যও একটু জায়গা চান – বিশেষ করে তার লম্বা সময়ের গুরু আন্নার পাশেই!”

কিন্তু এটা শুধু চেন্নাই শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একফালি জায়গা পাওয়ার ব্যাপার নয়।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকালীন ইতিহাসের অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলছেন, ভারতের রাজনীতিতে একজন নেতার উচ্চতা যে মানদণ্ডে মাপা হয় – মৃত্যুর পরও তা পুরাদস্তুর বহাল থাকে বলেই করুণানিধির সমাধিস্থল নিয়ে এই বিতর্ক।

তার কথায়, “এটা খুব স্বাভাবিক, কারণ সামাজিক হায়ারার্কি-র নিরিখেই ভারতের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয়। মেরিনা বিচে করুণানিধির সমাধির মধ্যে দিয়ে তার হায়ারার্কিটাই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে – যে ওখানে আর যাদের সমাধি আছে, তিনিও ঠিক সেই একই পর্যায়ের নেতা!”

“জাতপাত, ধর্ম, আঞ্চলিকতা সব মিলেমিশে এখানে একটাই হায়ারার্কি-র অবস্থানে করুণানিধিকে রাখা হচ্ছে, যেখানে তিনি আন্না, এমজিআর বা জয়ললিতার সমকক্ষ। হ্যাঁ, তিনি জয়ললিতার প্রতিপক্ষ হতে পারেন – কিন্তু মৃত্যুর পর এটা অন্তত প্রমাণ করা যাচ্ছে যে তিনি জয়ললিতার চেয়ে নেতা হিসেবে কোনও অংশে কম নন!” বলছিলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী

ভারতে জাতির জনকের মর্যাদায় ভূষিত মোহনদাস গান্ধীর সমাধি দিল্লির যে রাজঘাটে, তার আশেপাশে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য এক সময় বহু তদবির করেছেন প্রয়াত অনেক রাজনীতিকের পরিবারই।

নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব গান্ধী বা সাবেক প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং-লালবাহাদুর শাস্ত্রীরা মৃত্যুর পর সেখানে জায়গাও পেয়েছেন, আবার অনেকে পানওনি।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলছিলেন, “গান্ধীর সমাধির পাশে ঠাঁই পাওয়ার জন্য এত তাগিদও একটাই কারণে, ওই নেতা বা নেত্রীকে গান্ধীর সমতুল্য করে দেখানোর চেষ্টা। তবে দুটো ঘটনা আমার মনে পড়ছে, জগজীবন রাম বা পিভি নরসিমহা রাওয়ের পরিবার কিন্তু রাজঘাটে তাদের শেষকৃত্য করতে চেয়েও অনুমতি পাননি।

“এখন জগজীবন রাম যদি কখনও কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হতেন বা প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে তার পরিবার হয়তো সেই অনুমতি পেয়েও যেত। এই সব কিছুর পেছনেও যে রাজনীতি তাকেই, তা তো অস্বীকার করা যায় না!”

আদালত মেরিনা বিচেই করুণানিধিকে সমাহিত করার অনুমতি দেওয়ার পর তার ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী স্ট্যালিনের চোখ কেন আনন্দে ভিজে উঠেছিল, তা বোঝা তাই শক্ত নয়।

চেন্নাই শহরের কেন্দ্রে ওই মেমোরিয়াল আগামী বহু বছর ধরে ডিএমকে নামক রাজনৈতিক দলকে অক্সিজেন জোগাবে – যেভাবে এমজিআর ও জয়ললিতার মেমোরিয়াল জুগিয়ে আসছে তাদের প্রতিপক্ষ এআইডিএমকে-কে।

-বিবিসি বাংলা