দারিদ্র্য ডিঙিয়ে মা-মেয়ের জিপিএ-৫

চরম দারিদ্র্যর সঙ্গে লড়াই করে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করেছেন মা-মেয়ে। একসঙ্গে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দুজনই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ঘটনাটি নাটোরের।

নাটোরের বাগাতিপাড়ার মা-ছেলের একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার খবর পড়ে শুক্রবার বিকেলে নাটোর প্রতিনিধির কাছে হাজির হন এই মা ও মেয়ে। তাঁদের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামে। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে মা ও মেয়ে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করেছেন।

নওপাড়া গ্রামের দিনমজুর আজিজুর রহমানের স্ত্রী শিল্পী বেগম (৩৫) জানান, ১৬ বছর বয়সে তিনি যখন বিলমাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়তেন, তখন বিয়ের প্রস্তাব আসে। অন্তত এসএসসি পাস না করে বিয়ে করবেন না, এমন সিদ্ধান্তের কথা বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটনের কথা বলে বাবা-মা তাঁকে বিয়েতে রাজি করান। বিয়ের পর দেখেন স্বামীর সংসারেও অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ঘরে আসে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ওদের বড় করার চিন্তায় নিজের পড়ালেখার ইচ্ছাটা ইচ্ছাই থেকে যায়। সাহস করে স্বামীকে কখনো বলতেও পারেননি। তবে পড়ালেখা না করতে পারার কষ্টের কথাগুলো ছেলেমেয়েদের বলতেন। ওদের বাসায় যখন পড়াতেন, তখন নিজেও বইখাতা নাড়াচাড়া করতেন।

অবশেষে বড় মেয়ে আশা মণি যখন মোমিনপুর মাজার শরিফ দাখিল মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শাখায় এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করে, তখন তিনি তাঁর ইচ্ছাটা আর দমিয়ে রাখতে পারেননি। মেয়ের সঙ্গে তিনিও পরীক্ষার ফরম পূরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন স্বামীর কাছে। বিষয়টা জানতে পেরে বড় মেয়েও উৎসাহ দেয় মাকে। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঋণ করে ফরম পূরণের টাকা গোছালেন। অন্য কাউকে না বলে মা-মেয়ে মাদ্রাসায় গিয়ে ফরম পূরণ করেন ফুড অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগে। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এভাবে অংশ নেন পরীক্ষায়। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, মা-মেয়ে দুজনই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তাঁদের এ সাফল্য পরিবারে আনন্দ বয়ে এনেছে বলে হাসিমুখে তিনি তা জানালেন। আর পরিবারের বাইরে কেমন সাড়া পেলেন? জানতে চাইলে একটু হতাশা নিয়ে বলেন, বাইরের লোকজনের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখেননি; বরং অভাবের সংসারে কেউ কেউ মা-মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে কটূক্তি করতেও ছাড়েননি।

১৯ বছর সংসার করার পর কেন মেয়ের সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা হলো—জানতে চাইলে শিল্পী বেগম বলেন, ‘সংসারের অভাব-অনটনই আমাকে নতুন করে পড়ালেখার উৎসাহ জুগিয়েছে। ভেবেছি, নিজে আরও কিছু পড়ালেখা করতে পারলে আর যা-ই হোক গৃহশিক্ষকতা করেও কিছু উপার্জন করে স্বামীকে সহযোগিতা করা যাবে। নিজের জন্যও কিছু করার সাধ মিটবে।’ তাহলে আর কত দূর পড়বেন? এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো ফল করে আমার সাহস বেড়ে গেছে। স্বামী-সন্তানদের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। তাই আমি ইতিমধ্যে মেয়ের সঙ্গে মঞ্জিলপুকুর কৃষি ও কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। ইচ্ছা আছে শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা করব।’

শিল্পী বেগমের বড় মেয়ে আশা মণি জানায়, সে মাকে পরীক্ষা দেওয়াতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছে। ভালো ফল করাতে আরও খুশি হয়েছে। বাবা চাইলে সে মাকে সঙ্গে নিয়ে পড়ালেখা করে যাবে। সে আরও জানায়, কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে বাগাতিপাড়ার মা-ছেলের এসএসসি পাসের গল্প শুনে তারা মুগ্ধ হয়েছে। সারা দেশের মানুষ প্রথম আলোয় ওই খবর পড়ে মা-ছেলেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটা জানতে পেরে তারাও নিজেদের সাফল্য দেশবাসীকে জানাতে আগ্রহী হয়েছে।

আশা মণির বাবা আজিজুর রহমান বলেন, ‘বাইরে থেকে কোনো মানুষ আমার পরিবারের সদস্যদের সংগ্রামের কথা অনুমান করতে পারবে না। কারণ আমরা কারও কাছে খুব সহজে সহযোগিতার জন্য যাই না। মান সম্মানের কথা ভেবে এক বেলা না খেয়ে ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি আমার স্ত্রীর পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা গুছিয়েছি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রতি সহায় হয়েছেন। আমি আমার সাধ্যমতো স্ত্রী ও সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাব।’প্রতিবেদন প্রথম আলোর সৌজন্যে প্রকাশিত।