ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনও অর্ধশত ইয়াবা গডফাদার

শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করে নজির স্থাপন করল। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, উপজেলা চেয়ারম্যান জাফরসহ অর্ধশত গডফাদার ও নেপথ্যের পুলিশ কর্তারা। এখনো থেমে নেই পর্দার আড়ালে থাকা এসব গডফাদারের ইয়াবা ব্যবসা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, এদের নির্মূল করতে না পারলে আলোর মুখ দেখবে না সরকারের মাদক নির্মূলের মিশন।

জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় এসব গডফাদারের নাম রয়েছে। তবু তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে। বদির বিষয়টি নিয়ে ‘জলঘোলা’ কম হয়নি। কিন্তু তিনি বরাবরই দাবি করেন, ‘আমি নির্দোষ’। তালিকায় থাকা শীর্ষ ব্যবসায়ী ও নেপথ্যের গডফাদারদের মধ্যে অধিকাংশই রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে ঘাপটি মেরে। তাদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর অর্ধশত কর্মকর্তাও।

অবশ্য সাবেক সংসদ সদস্য বদিকে প্রধানমন্ত্রী নীতিগত কারণে ‘অঘোষিত’ ‘পানিশমেন্ট’ দিয়েছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না দিয়ে। তবে মনোনয়ন পেয়ে বদির স্ত্রী বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, কক্সবাজারের ধনকুবেরদের একজন হচ্ছেন বদি। দলের জন্য এবং এলাকার মানুষের জন্য দুই হাতে খরচ করেন। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে বদি পরিবারের রয়েছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। বদির পরে শীর্ষে রয়েছেন টেকনাফের বহুল আলোচিত টিটি জাফর। এই টিটি জাফরের সিন্ডিকেটের ১০ সদস্য টেকনাফে অবস্থান করে নানাভাবে ইয়াবা ব্যবসার অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। যাদের মধ্যে জালিয়াপাড়ার তাহের, আবদুল আলী, লেঙ্গা কামাল, সাইফুল, খুরশিদ অন্যতম।

এ ছাড়া আবদুর রহমান বদির ভাই কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল করিম, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন, টেকনাফের নরুল হক ভুট্টো, ছিদ্দিক আহমদ। এসব শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ না করে এখনো ঘাঁপটি মেরে আছে। স্থানীয়দের দাবি, এসব গডফাদারকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে এ অঞ্চলে ইয়াবা ব্যবসা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।

মাদক ব্যাবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বলেন, আত্মসমর্পণের ঘটনাটি মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা দায়িত্বশীল সমাজপতি বা পুলিশ কর্মকর্তা, তারা যদি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে?

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা কয়েকজন ইয়াবা কারবারির বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ইয়াবা পাচার, অর্থ লেনদেনসহ নানা বিষয়ে অনেক বড় বড় গডফাদার রয়েছে। মূলত এরাই ইয়াবা পাচারের নেপথ্যে কাজ করছে।

আত্মসমর্পণকারীরা জানায়, তাদের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বলা হলেও নেপথ্যে একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। যে চক্রের সদস্যদের কারো নাম এখনো প্রশাসন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো তালিকায় আসেনি। তারা নেপথ্যে অবস্থান করে এদের (আত্মসমর্পণকারী) দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

অবশ্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আত্মগোপনে থাকা ইয়াবা কারবারিদের উদ্দেশে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, স্বাভাবিক জীবনে না এলে আপনাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে ইয়াবার গডফাদাররা ‘মাস্টার প্ল্যান’ করে নিজেদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। মূল গডফাদাররা থাকে চার পাঁচ স্তর নিচে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবার চালান ধরা পড়লেও আসল গডফাদাররা বরাবরই রয়ে যায় পর্দার আড়ালে। বহনকারী আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

ইয়াবার মূলোৎপাটন করতে হলে উৎস বন্ধ করার পাশাপাশি, গডফাদারদের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে কোনোভাবেই পাচার হয়ে আসা ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না।