ধর্মযাজকের মেয়ে থেকে ইউরোপের সম্রাজ্ঞী

জার্মানির ক্ষমতাসীন দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেট দলের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল। শুক্রবার এক আবেগময় বিদায়ী ভাষণে মের্কেল তার দেশের ভেতরে এবং বাইরে জার্মানির উদার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সুদীর্ঘকাল মের্কেল জার্মানির ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন।

নিজেকে তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসাবে প্রমাণ করেছেন। এক সময় তাকে বর্ণনা করা হতো জার্মানির রাণী হিসাবে। এমনকি কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ইউরোপের সম্রাজ্ঞী বলেও।

আঠারো বছর তিনি তার দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর পরপর চার মেয়াদে দেশটির চ্যান্সেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দলের নেতৃত্ব এখন ছাড়লেও চ্যান্সেলর হিসেবে তার চতুর্থ মেয়াদ শেষ করবেন ২০২১ সালে। তখনই দেশটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মের্কেল।

কাজেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির নেতৃত্বে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকলেও এটা এক অর্থে হবে সাময়িক দায়িত্বপালন। মের্কেলের ক্ষমতার শক্ত ভিত প্রথম নড়ে যায় যখন শরণার্থীদের জন্য জার্মানির উন্মুক্তদ্বার নীতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে তাকে পড়তে হয়।

তার এই নীতির ফলশ্রুতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেশটির চরম ডান-পন্থীরা এবং তার দল প্রায় ৭০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে ২০১৭ সালে। মের্কেল বলেছেন, কোন রাজনৈতিক পদ নিয়ে তার ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দুই জার্মানি একত্রিত হবার পর থেকে তিনি কোন না কোন রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন পর্যন্ত একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন।

ধর্মযাজকের কন্যা থেকে রাজনীতির অঙ্গনে:

১৯৫৪ সালের ১৭ই জুলাই জার্মানির হামবুর্গ শহরে মের্কেলের জন্ম। যখন তার বয়স মাত্র দু’মাস তখন তার বাবাকে পূর্ব জার্মানির এক ছোট্ট শহরের এক গির্জার ধর্মযাজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে একটি গ্রাম্য এলাকায় বড় হয়েছেন মের্কেল। পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট করে তিনি কাজ নেন পূর্ব বার্লিনের একটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে রসায়নবিদ হিসাবে। ১৯৭৭ সালে সহপাঠী ছাত্র উলরিখ মের্কেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু চারবছর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

১৯৮৯ সালের মধ্যে তিনি পূর্ব জার্মানিতে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বার্লিন প্রাচীর যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখন পূর্ব জার্মানিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের মুখপাত্র হিসাবে কাজ নেন।

১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণের দু’মাস পর তিনি মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাট পার্টিতে (সিপিইউ) যোগ দেন। পরের বছর চ্যান্সেলার হেলমুট কোলের সরকারে তিনি মহিলা ও তরুণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। কোল অবৈধ অর্থ লেনদেনের এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে মের্কেল ১৯৯৯ সালে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০০ সালে সিপিইউ দলের নেতা নির্বাচিত হন মের্কেল। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর হন।

জার্মানিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে টেনে তোলা:

তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়াতে তাকে দেখা হতো অনাকর্ষণীয় প্রাদেশিক সাদামাটা একজন নেতা হিসাবে। কিন্তু প্রথম থেকেই সেই ভাবমূর্তি তিনি ঝেড়ে ফেলতে উদ্যোগী হন তার পোশাক আশাক ও চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তিনি চুলের স্টাইল বদলান, উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন।

তিনি ১৯৯৮ সালে ইয়োকিম সয়ারকে বিয়ে করেন তিনি। তার প্রথম সরকার তিনি গঠন করেন মধ্য বামপন্থী স্যোসাল ডেমোক্রেটদের সঙ্গে একটা মহাজোট করে।

এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ব্যবসা-বান্ধব ফ্রি ডেমোক্রেট দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেন। ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি ব্যয় সঙ্কোচের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ইউরোপের উপর্যুপরি ঋণ সমস্যার মোকাবেলায় তিনি ব্যাপক বাজেট হ্রাস এবং কড়া নজরদারির সুপারিশ করেন।

সমালোচকরা বলেন তিনি অর্থসঙ্কট সামাল দিতে বাড়তি অর্থসাহায্য দেবার ব্যাপারে প্রথমদিকে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ইউরোজোনের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জার্মানিই পরে সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং ইউরোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইইউর প্রয়াসের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন মের্কেল।

গ্রিস ও স্পেনে বিক্ষোভকারীরা ব্যয়সঙ্কোচন নীতি বলবৎ করার জন্য জার্মানিকে দোষারোপ করে এবং মের্কেলকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু এই সঙ্কটের মধ্যে জার্মানির শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান, বেকারত্বের নিচু হার এবং বেশ ভাল মাত্রার রপ্তানি দেশের ভেতর তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। জার্মানির মানুষ ব্যাপকভাবে মনে করে কঠিন সময়ে তিনি দেশের জন্য নিরাপদ একজন নেতা।

২০১৩ সাল নাগাদ ব্যয়সঙ্কোচ নীতি সম্পর্কে তিনি অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব নেন। তিনি বলেন বেকারত্ব সমস্যা মোকাবেলার জন্য ইউরোপের শ্রমবাজার আরও উন্মুক্ত করা দরকার, যাতে তরুণরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ খোঁজার সুযোগ পান।