‘ধর্ষণের আগে থেঁতলে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা নারীদের শরীর’

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলছে দেশটির সেনাবাহিনীর হত্যা,ধর্ষণ ও নির্যাতন। সেখান থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মুখে সেসব কাহিনীর ভয়াবহতা শুনলে গা শিউরে ওঠে। তাঁরা নিজের সামনে কাছের মানুষগুলোকে হত্যা করতে দেখেছে, জ্বলতে দেখেছে তাঁদের গ্রাম। হানাদারদের পাশবিকতা এখানেই শেষ নয়। রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে তাদের স্বামী-সন্তানের সামনেই। পার পায়নি গর্ভবতীরাও।

ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার একটি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের কর্মী নওরিন তাসনুভা। তিনি জানান, সাধারণত পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যখন বাড়ির বাইরে থাকে তখনই গ্রামগুলোতে হামলা চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারপর শিশুদের সামনেই ধর্ষণ করা হয় তাদের।

নওরিন আরো জানান, ধর্ষণের আগে রোহিঙ্গা নারীদের মারধর করে সেনা সদস্যরা। থেঁতলে দেওয়া হয় তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। ধর্ষণের শিকার অনেক নারীর শরীরে থেঁতলানো দাগ দেখেছেন তিনি। এ ছাড়া চিকিৎসা দেওয়ার সময় তাদের বুক ও যৌনাঙ্গে কামড়ের দাগ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনাগুলো আড়ালেই থেকে যায়। কারণ নারীরা লজ্জা ও ভয়ের কারণে এ কথাগুলো কাউকে জানাতে চায় না। এমনকি তাদের পরিবারকেও না।

রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও তাঁরা যুগের পর যুগ ধরে মিয়ানমার রাষ্ট্রের নিগ্রহের শিকার। সম্প্রতি সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পে ‘বিদ্রোহীদের হামলার’ পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নতুন করে হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর এতে তাদের সহযোগিতা করছে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ও মগরা।

জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রায় চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম পুরুষদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে, নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম তাঁরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এমন একজন নারী শামিলা (২৫)(ছদ্মনাম)। শক্ত হাতে সন্তানের হাত ধরে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলেন। সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইট টাইমসকে তিনি বলেন, সেনা সদস্যরা দরজা ভেঙে তাঁর ঘরে ঢুকে । তারপর সন্তানদের সামনেই গণধর্ষণ করে।

সেদিনের বিভীষিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামিলা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, তিনদিন হেঁটে বাংলাদশে পৌঁছান তিনি। বাংলাদেশে পৌঁছানোর পরও ধর্ষণের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরেই যাচ্ছিল।

রোহিঙ্গা ওই নারী বলেন, ‘তিনজন সেনা আমাকে ধর্ষণ করেছিল। বারবার। তারপর তাঁরা যখন চলে গেল আমি বাড়ির বাইরে গিয়ে আমার দুই সন্তানের হাত ধরে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে লাগলাম।’

শামিলা জানান, ঘটনার সময় তাঁর স্বামী বাড়িতে ছিলেন না। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা নেই। জানেন না তাঁর অন্য সন্তানরা কোথায় আছে, কেমন আছে। তিনি যখন পালান, তখন তাঁর অন্য সন্তানরা বাইরে খেলতে গিয়েছিল।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার আরেক কর্মী আইরিন লোরিয়া জানান, মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গা নারীদের খেলনা হিসেবেই দেখত। তাদের নগ্ন করে গ্রামে প্যারেড করাতো। হেয় করার জন্য বিভিন্ন কুৎসিত কথা বলত। কিন্তু এখন ধর্ষণ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।

আয়েশা (২০) নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী জানান, একদিন সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনী তাঁর গ্রামে হামলা চালায়। তখন তাঁর স্বামী বাড়ি ছিলেন না। প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশীরা সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোলে দুধের শিশু থাকার কারণে পালাতে পারেননি তিনি। হামলার একপর্যায়ে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়ে পাঁচ সেনাসদস্য। এরপর একজন সেনা তাঁকে ধর্ষণ করে। আর বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আয়েশা-শামিলার মতো কাহিনীগুলো একেবারেই হাতেগোনা। ভেতরের সত্যটা আরো গভীর। মিয়ানমারে এমন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই ভয়ে তা প্রকাশ করছেন না। বর্তমানে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষা করাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সাহায্যকারী বিভিন্ন দেশের কাছে। ফলে ধর্ষণের শিকার নারীদের দিকে অতটাও নজর দিতে পারছে না তাঁরা। কিন্তু মিয়ানমারে এ ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা বিপর্যয়ের আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।