নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ

বাফেলো পার্কের জায়ান্ট স্ক্রিনে বেশ কয়েকবার ভেসে উঠলো অভিনন্দন বার্তাটা। মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্য। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে তার ফিফটি করা বা পঞ্চাশতম ম্যাচের উপলক্ষ্যে। এমন উপলক্ষ্য বা মাইলফলকের দিনে আগে টাইগারদের আরো উজ্জীবিত লাগতো। বেশ কিছু মাইলফলকের ম্যাচ জেতার রেকর্ড আছে। সেদিন তো শ্রীলঙ্কায় দেশের শততম টেস্টটাও জিতল। কিন্তু মাশরাফি এবং বাংলাদেশ দল নিশ্চয়ই এখন পর্যন্ত আফ্রিকার মাটিতে এবার যা হলো, তা দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাইবেন না। রোববার যে ইস্ট লন্ডনে আরেকটি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে শেষ হলো বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজটা। হোয়াইটওয়াশ। ২০০ রানের হারে!

হোয়াইটওয়াশ শব্দটা বড় নির্মম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজে আরো এলোমেলো টাইগাররা। মাশরাফির যে দলকে এখন সবার সমীহ করতে হয় সেটির প্রথম ম্যাচে লজ্জার ১০ উইকেটের হার, পরেরটিতে ১০৪ রানে পরাজয়। আর শেষ ওয়ানডেটা শেষ হলো ২০০ রানের হারে। ৪০.৪ ওভারে ১৬৯ রানে অল আউট।

৩৭০ রানের পাহাড়ের নিচে আগেই চাপা পড়া হয়ে গিয়েছিল টস হেরে। তারপর ব্যাটসম্যানদের যাওয়া আসার মিছিলে ৬১ রানে নেই ৫ উইকেট। আর কি থাকে? তখন আর চাপ নেই। সাকিব আল হাসান ৬৩ আর সাব্বির রহমান ৩৯ রান করেন। স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের আর কারো দুই অঙ্কের রানেই নেই! ৩-০ তে সিরিজ শেষ নিজেদের ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের ব্যবধানের হারে। এর আগে আছে পাকিস্তানের কাছে ২৩৩ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ২০৬ রানের হার। কিন্তু সেটা তো ২০০০ এবং ২০১১ সালের কথা! ২০১৭ সালে এসে খেলোয়াড় হিসেবে নিজের শেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে মাশরাফি অধিনায়ক হিসেবেও নিশ্চয়ই খুব নতজানু।

৩৭০ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকার পেসারদের তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ড্যান পিটারসনের বলে মিড অফে সহজ ক্যাচ তুলে দেন ইমরুল কায়েস। ভাবখানা এমন যেন প্রোটিয়াদের ক্যাচিং অনুশীলন করাচ্ছিলেন তিনি। ফারহান বেহারডিনও সে ক্যাচ লুফে নেন অনায়াসে। ফলে ব্যক্তিগত ১ রানেই সাজঘরে হাঁটতে হয় ইমরুলকে।

এরপর পিটারসনের দ্বিতীয় শিকার লিটন কুমার দাস। উইকেটে নেমেই কিছুটা হাত খুলে মারার চেষ্টা। পিটারসনের বলটি ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে ব্যাটে বলে না হলে আঘাত লাগে প্যাডে। ৬ রানে আউট লিটন। লিটনের আউটের ধাক্কা সামলে না উঠতে উঠতেই আউট হন সৌম্য সরকার (৮)। কাগিসো রাবাদার বলে স্লিপে আইডেন মারকরামের হাতে ধরা পড়েন তিনি। সিরিজের প্রথম ম্যাচেও ব্যর্থতা সৌম্যর!

চতুর্থ উইকেট জুটিতে বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল মুশফিকুর রহীম ও সাকিবের ব্যাটের দিকে। কিন্তু আন্ডিলে ফেহলুকওয়ায়োর বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ৩০ গজের সীমানাও পার করতে পারেননি মুশফিক (৮)। যোগ দেন উইকেট হারানোর মিছিলে। এরপর নেমে বেশিক্ষণ স্থায়ী হননি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও (২)।

ষষ্ঠ উইকেটে সাব্বির রহমানকে নিয়ে কিছুটা লড়াইয়ে আশা দেখাচ্ছিলেন সাকিব। কিন্তু এ দুই ব্যাটসম্যানই আউট হয়েছেন অভিষিক্ত আইডেন মারকরামের বলে। পার্টটাইম বোলার মারকরামের বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ডুমিনির হাতে ধরা পড়েন সাকিব। আউট হওয়ার আগে ৬৩ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। আর ব্যক্তিগত ৩৯ রানে উইকেটরক্ষক কুইন্টন ডি ককের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাব্বির। এরপর শেষের দিকের ব্যাটসম্যানরা বলার মতো কিছু না করতে পারলে ৪০.৪ ওভারে ১৬৯ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ।

এর আগে প্রথমে ব্যাট করতে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে নতুন বল হাতে নেন এ সিরিজে এদিনই প্রথম মাঠে নামা মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে সুবিধা করে উঠতে পারেননি শুরুতে। প্রথম ওভারে তাকে তিনটি চার মারেন প্রোটিয়া ওপেনার কুইন্টন ডি কক। বুঝিয়ে দেন কোন পথে হাঁটছেন দুই ওপেনার। পরে সেই মিরাজই দুই ওপেনারকে আউট করে বাংলাদেশকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিলেন। তবে এর আগে দুই ওপেনারের হাত ধরে উড়ন্ত সূচনাই পায় স্বাগতিকরা।

১১৯ রানের ওপেনিং জুটির পর টাইগারদের ব্রেক থ্রু এনে দেন মিরাজ। তার বলে লং অন দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে লিটন দাসের হাতে ধরা পড়েন বাভুমা। আউট হওয়ার আগে ৪৭ বলে ৪৮ রান করেছেন তিনি। এরপর স্কোরবোর্ডে ১৩ রান যোগ হতেই প্রোটিয়া শিবিরে দ্বিতীয় আঘাত হানেন মিরাজ। তার বলে ডি ককের ব্যাটের কানায় লেগে শুন্যে উঠে গেলে নিজেই ক্যাচ ধরেন। ৬৮ বলে ৭৩ রান দিয়ে গেছেন ডি কক।

কিন্তু এরপর সে ধারা ধরে রাখতে পারেনি টাইগাররা। তৃতীয় উইকেটে এ ম্যাচেই অভিষেক হওয়া আইডেন মারকরামকে নিয়ে দারুণ এক জুটি গড়েন ডু প্লেসি। ১৫১ রানের কাব্যিক জুটিটি হতে পারতো আরও বড়। তবে মাশরাফির করা ইনিংসের ৪১তম ওভারে দ্রুততার সঙ্গে প্রথম রান নেওয়ার পর দ্বিতীয় রানের জন্য দৌড়াতে গিয়েই সর্বনাশ করেন তিনি। পেশীতে টান লাগায় মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন প্রোটিয়া অধিনায়ক। ফলে ব্যক্তিগত ৯১ রানেই রিটায়ার্ড হার্ট তিনি।

ডু প্লেসি মাঠ ছাড়ার পর বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মারকরাম। ইমরুল কায়েসের দারুণ এক থ্রোতে রান আউট হন তিনি। এরপর দ্রুত আরও ৩টি উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ দিকে ফারহান বেহারডিন ও কাগিসো রাবাদার ঝড়ে ৩৬৯ রানের বড় সংগ্রহই পায় দলটি। ফারহান ৩৩ রান করেন ২৪ বলে। আর রাবাদা ১১ বলে করেন অপরাজিত ২৪ রান। বাংলাদেশের পক্ষে দুটি করে উইকেট পান মিরাজ ও তাসকিন। ১টি উইকেট নেন রুবেল। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাফেলো পার্কের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দলীয় সংগ্রহ হয়ে গেছে। আর বাংলাদেশের এই সফরে যে অবস্থা তাতে লড়াইটা কোনোভাবেই ব্যাট হাতে জমানোর আশা ছিল না, জমেওনি।

বাংলাদেশ : ৪০.৪ ওভারে ১৬৯ (ইমরুল ১, সৌম্য ৮, লিটন ৬, মুশফিক ৮, সাকিব ৬৩, মাহমুদউল্লাহ ২, সাব্বির ৩৯, মিরাজ ১৫, মাশরাফি ১৭, তাসকিন ২, রুবেল ০*; রাবাদা ১/৩৩, পিটারসন ৩/৪৪, মালডার ১/৩২, তাহির ২/২৭, ফেহলুকওয়ায়ো ১/১৩, মারকরাম ২/১৮)

দক্ষিণ আফ্রিকা : ৫০ ওভারে ৩৬৯/৬ (বাভুমা ৪৮, ডি কক ৭৩, ডু প্লেসি ৯১, মারকরাম ৬৬, ডি ভিলিয়ার্স ২০, বেহারডিন ৩৩*, মালডার ২, ফেহলুকওয়ায়ো ৫, রাবাদা ২৩*; মাশরাফি ০/৬৯, মিরাজ ২/৫৯, রুবেল ১/৭৫, সাকিব ০/৫৬, তাসকিন ২/৬৬, মাহমুদুল্লাহ ০/৩৩, সাব্বির ০/৮)।

ম্যাচের ফল : দক্ষিণ আফ্রিকা ২০০ রানে জয়ী।

সিরিজের ফল : দক্ষিণ আফ্রিকা ৩ ওয়ানডের সিরিজ ৩-০ তে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ : ফ্যাফ ডু প্লেসি।

সিরিজ সেরা খেলোয়াড় : কুইন্টন ডি কক।