নিখোঁজরা ঘরে ফিরলেও নিশ্চুপ কেন?

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হলে নানান নাটকীয়তার পর মিলেছে সন্ধান। তবে এসব ঘটনায় থানায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা তদন্তে কোনটির অগ্রগতি নেই। নিখোঁজ ব্যক্তি ঘরে ফিরে আসলেও স্বজনরা এসব মামলা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মামলা তদন্তে সদিচ্ছার অভাব দেখা যায়।

তাছাড়া পরিবার বা স্বজনরা ভয়ে এতোই ভেঙে পড়েন যে, নিখোঁজের ঘটনা তারা ভুলে যেতে চান। তাই নিখোঁজের পর ফিরে আসা ব্যক্তিরা কখনও মুখ খুলছেন না।

সর্বশেষ ১১ দিন নিখোঁজ থাকার পর বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোরে ময়মনসিংহের তারাকান্দা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে ইফতেখার আলম সৌরভকে। সোহেল তাজ বলেছেন, তার অবস্থা ভালো ছিল না এবং সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। পুলিশ বলছে, উদ্ধার হওয়ার পর নিখোঁজের ব্যাপারে কোনো কথাই বলছেন না সৌরভ।

সোহেল তাজ বলেন, সৌরভকে যখন পাওয়া যায় তখন তার হাত-পা বাঁধা ছিলো। গায়ে কোনো জামা ছিল না, শুধু পায়জামা পরা ছিল। তার চোখ বাঁধা ছিল। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার তাকে বাসায় নিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করেন এবং কিছু খাবার দেন। উদ্ধারের পর সৌরভ বুঝেই উঠতে পারেনি সে কোথায়। সৌরভের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার বিষয়টি জানিয়ে সোহেল তাজ বলেন, সে মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত। এখন তাকে চাপমুক্ত রাখতে চাই। আমরা তাকে একটু স্বস্তিতে রাখতে চাই। সৌরভ আভাসে ইঙ্গিতে কিছুটা জানিয়েছে, সে কী পরিস্থিতিতে ছিলো। তবে এখন তার ওপর কোনো চাপ দেয়া যাবে না। কোনো কথা বলা যাবে না।

এর আগে নিখোঁজ হওয়ার ৪৬৭ দিন পর ফিরে আসেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। গভীর রাতে তিনি নিজ বাসায় ফিরেছেন। তবে এতোদিন তিনি কোথায় ছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। দীর্ঘদিন পর বাবাকে ফিরে পেয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন মারুফ জামানের মেয়েরা। তবে তার নিখোঁজ থাকা বা কোথায় ছিলেন এবং ফিরে আসার ব্যাপারে তারা মুখ খুলছেন না। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাতে ধানমণ্ডির বাসার সামনে দিকভ্রান্তের মতো ঘুরছিলেন মারুফ জামান। তাকে দেখতে পেয়ে দারোয়ান তার মেয়েকে খবর দেন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, অপহরণকারীরা মারুফ জামানের পকেটে কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দেয়। এরপর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে তিনি বাসায় ফেরেন। মানসিকভাবে অসুস্থ মারুফ জামান।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমণ্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এডিসি) আবদুল আজিজ বলেন, গভীর রাতে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার বাসার পাশে ভবঘুরের মতো হাঁটছিলেন মারুফ জামান। পরে স্থানীয়রা ও দারোয়ান তাকে চিনতে পেরে বাসায় দিয়ে আসেন। আমরা এখনো তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। তার মেয়ে জানিয়েছেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একটু সুস্থ হলে তার সঙ্গে কথা বলবো। তবে সেই বলার সময়টা আর আসেনি।

উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, ১৬ দিন একটি ঘরে চোখ-হাত বেঁধে আটকে রাখার পর গত বছর ১২ এপ্রিল কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর ভাইয়ের বন্ধু মিজানুর রহমান সোহাগ বাড়ি ফিরেছেন। পরিবারের অভিযোগ, গত বছর ২৭ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়। এই ঘটনায় তার বাবা নুরুল ইসলাম ৩০ মার্চ বুড়িচং থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে তদন্তে বুড়িচং থানার পুলিশ এ বিষয়ে এখনও কিছু পায়নি। সোহাগ কীভাবে অপহৃত হয়েছিলেন? অপহরণের সঙ্গে কারা জড়িত? তাদের শনাক্ত করা গেছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উত্তম কুমার কোনো তথ্যও দিতে পারেননি।

এর আগে নিখোঁজ হন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা। রাত ১টার দিকে রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকা থেকে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরিবার ও স্বজনদের দাবি তাকে অপহরণ করা হয়েছিলো। ঘটনার এক সপ্তাহ পর তাকে বিমানবন্দর এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখে আইনশৃংখলা বাহিনী বাসায় দিয়ে আসেন। তবে এই ঘটনার পর জোহা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে আর কথা বলেননি। তার পরিবারও কথা বলতে রাজি হননি।

একই বছরের ২ জানুয়ারি শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবীশ চিকিৎসক শামীম খান তপু অপহৃত হন। ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মিন্টো রোড থেকে তাকে উদ্ধার করেছিলো। তপুকে অপহরণের পর চিকিৎসকরা আন্দোলনের হুমকি দেয়। আল্টিমেটাম দেয়। এর ৩০ ঘণ্টা পরই তিনি ফিরে আসেন। এ ঘটনায় শেরে বাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। তপুকে কারা অপহরণ করেছিলো, তা জানা গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিজি বিশ্বাস বলেন, তপুর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার সময় রহস্যজনকভাবে অপহৃত হন বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। অপরহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর তিনি ফিরে আসেন। গত দুই বছরেও অপহরণের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাকের হাতে।

২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ছেলেকে বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজের গাড়িতে বাসায় ফিরছিলেন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার আবুল হাসানাত পলিন। স্কুলগেট থেকে গাড়ির সামনে যেতেই একটি মাইক্রোবাস পলিনের গতিরোধ করে। দুর্বৃত্তরা পলিনকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। দুই মাস ১০ দিন নিখোঁজের পর রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে যায় অপহরণকারীরা। এই ঘটনায় দায়ের করা অভিযোগের তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেছে আদালত। এ বিষয়ে পলিন জানান, যা বলার আদালতে বলেছি। এর বাইরে কিছু বলার নেই।

২০১৪ সালে সুনামগঞ্জ থেকে অপহরণের সাড়ে তিন মাস পর টঙ্গীতে পাওয়া যায় বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমানকে। সেই রহস্য আজও অজানা।

২০১৫ সালের ১০ মার্চ গভীর রাতে রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কে ৪৯/বি নম্বর বাড়ির ২/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবার ও তার দল বিএনপি অভিযোগ করে। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ১১ মে মেঘালয়ের শিলংয়ে সালাহউদ্দিনের সন্ধান মেলে। তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে একটি মামলা করে পুলিশ। দীর্ঘদিন তাকে শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২০ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেগ্রিমস হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেয়ার পর আদালতে হাজির করা হলে দুই সপ্তাহের পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। পরে শর্ত সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পান সালাহউদ্দিন। এখন তিনি সেখানেই আছেন। এই ঘটনায় ১১ মার্চ রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। ১২ মার্চ তিনি উচ্চ আদালতেও একটি আবেদন করেন। আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সালাহউদ্দিনকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশনা দেন। ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সালাহউদ্দিন নিজেই আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার রহস্য আর বের হয়নি। এখনও এর তদন্ত চলছে।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান জিয়া খান বলেন, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর রহস্য উদঘাটন করা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। তারা সেটা করতে পারলে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসবে।