নিজেই পরিচয়-বৃত্তান্ত দিলেন `হঠাৎ বিখ্যাত’ আলিস

বাইরের দুনিয়ার কথা ভুলে যান। গতকালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনেই তিনি ছিলেন অচেনা একজন। ক্রীড়া সাংবাদিকেরা তো বটেই; ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও তার ক্রিকেটীয় বৃত্তান্ন সেভাবে জানতেন না। সবারই মনে প্রশ্ন, কে এই আলিস? তিনি বাংলাদেশি তো? সেই অচেনা আলিসই মুহূর্তের জাদুতে দেশ ছাপিয়ে এখন বিশ্ব গণমাধ্যমেরও খোরাক। অভিষেকেই হ্যাটট্রিকের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে অখ্যাত থেকে হয়ে গেছেন বিখ্যাত। জিরো থেকে হিরো।

তা হঠাৎ খ্যাতির আলো যখন গায়ে লেগেছেই, তার পরিচয়-বৃত্তান্ত তো জানা দরকার। কে দেবে তার পরিচয়? সংবাদকর্মীদের কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে এলেন হ্যাটট্রিক নায়ক আলিস আল ইসলাম নিজেই। গতকাল ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নিজেই শোনালেন নিজের ক্রিকেটার জীবনের অজানা গল্পটা।

প্রথমেই জানালেন, বিপিএল তো বটেই; খেলেননি ঢাকার প্রিমিয়ার লিগেও। এমনকি এর আগে স্টেডিয়ামেই ক্রিকেট খেলেননি কখনো! মানে ইট-কংক্রিটের স্টেডিয়ামে কালই খেললেন প্রথম। সেটাও একেবারে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে। রূপকথার গল্প কাকে বলে!

অভিজ্ঞতা বলতে ঢাকার প্রথম বিভাগে খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতার জোরেই ঢাকা ডায়নামাইটসের নেট বোলার হন। নেটেই তাকে আবিষ্কার করে ফেলেন ঢাকা ডায়নামাইটসের কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন। নেটে ২২ বছর বয়সী আলিসের স্পিনে সুজন এতোটাই মুগ্ধ হন যে, দ্বিধাহীনচিত্তে তাকে দল ঢুকিয়ে নেন কোচ সুজন। পরের টুকু তো ইতিহাসই।

এবারের বিপিএলে ঢাকার শুরু হয়েছে দারুণ। প্রথম দুই ম্যাচেই জয়। ড্রেসিংরুমের এই জয়জয় অবস্থার মধ্যেই কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন একটা বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে হাই-ভোল্টেজ ম্যাচের আগের দিন অর্থাৎ পরশু আলিসকে জানিয়ে দেন ‘তুমি কাল খেলছ।’

মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যই সিদ্ধান্তটা আগের দিন জানিয়ে দেন সুজন। কোচ সুজনের সেই আস্থার প্রতিদান যে আলিস এতোটা অবিশ্বাস্যভাবে দেবেন, সেটা নিশ্চয় সুজনও কল্পনা করতে পারেননি। কল্পনা করার কথাও নয়। কারণ, আলিস অভিষেকেই যা করেছেন, তা কল্পনাতীত। এমন কিছুর স্বপ্ন দেখা যায় না!

যাই হোক, পূর্ব সিদ্ধান্ত মতোই ঢাকার হয়ে কাল বিপিএলে অভিষেক হয় তার। কিন্তু অভিষেক ম্যাচটায় ব্যাট করার সুযোগ পাননি। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলও দিয়েছেন দেরিতে। মানে ঢাকার বোলিংয়ের সময়ও প্রথম দিকে শুধুই ফিল্ডিং করা ছিল আলিসের কাজ।

সেই ফিল্ডিং করতে গিয়েই বড় দুটি ভুল করে বসেন আলিস। আনাড়ি হাতে ফেলে দেন মোহাম্মদ মিঠুনের দু-দুটি ক্যাচ! ঢাকা ম্যাচটা হারলে নিশ্চিতভাবেই তিনি হতেন ভিলেন। কিন্তু নিয়তি সেই আলিসকেই বানিয়ে দিলো নায়ক। ঢুকিয়ে দিলো ইতিহাসের পাতায়।

পর পর ৩ বলে সেই মিঠুন, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও ফরহাদ রেজাকে আউট করে অভিষেকেই করলেন হ্যাটট্রিক। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তো বটেই; প্রথম বিভাগ টি-টুয়েন্টিতেও অভিষেকে হ্যাটট্রিক কীর্তি বিশ্বে আর কারো নেই। মানে ইতিহাসে আলিসই প্রথম গড়লেন এই কীর্তি।

অবিশ্বাস্য হ্যাটট্রিক করে ম্যাচের চাকাটাও ঘুরিয়ে দিলেন নাটকীয়ভাবে। তার মোহনীয় স্পিন জাদুতেই এক সময় রংপুরের জয়কে নিয়তি মনে হওয়া ম্যাচে জিতল ঢাকা। সব মিলে ৪ ওভারে ১৫ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরাও তিনি। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার প্রতিনিধি হয়ে আসলেন তিনিই। প্রথম বারের মতো জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের ডেস্কে বসে পরিচয় দিলেন নিজের!

এমনকি নিজের নামটাও জানিয়ে দিতে হলো তাকেই, ‘আমি আলিস আল ইসলাম। ঢাকা ডায়নামাইটসের নেট বোলার ছিলাম। আমি আগে ঢাকার প্রথম বিভাগে খেলেছি। নেটে বোলিং করার সময় সুজন স্যার (খালেদ মাহমুদ সুজন) আমাকে দেখেন। দেখে ওনার বিশ্বাস হয় যে, আমি ভালো করতে পারব। এরপর আমাকে দলে নেন তিনি। পরে টিম ম্যানেজমেন্ট, খেলোয়াড়েরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। সেখান থেকেই আজকের একাদশে।’

আগের দিনই ম্যাচ খেলার সুসংবাদ পেয়ে যাওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘গতকাল (পরশু) সন্ধ্যায় জানতে পারি আমি খেলব। সুজন স্যার আমাকে ডেকে বলেন, মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে। আমি প্রস্তুতই ছিলাম।’ এতো বড় স্টেডিয়াম, এতো বড় টুর্নামেন্টে খেলা, নার্ভাস লাগছিল না? আলিস নিজে থেকেই বললেন, ‘ব্যাপারটা তো নার্ভাস হওয়ার মতোই। প্রথমে আমি নার্ভাস ছিলাম। তারপরও ভালো হয়েছে।’

শুরুতে দু-দুটি ক্যাচ ফেলা। সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে হ্যাটট্রিক! অবিশ্বাস্য এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘বিপিএলে এটাই আমার প্রথম ম্যাচ। আসলে স্টেডিয়ামেই এটা আমার প্রথম ম্যাচ। আমি সত্যিই অনেক নার্ভাস ছিলাম। তবে ক্যাচ দুটি ড্রপ করার পর সতীর্থরা আমাকে অনেক সাহস দিয়েছে। কোচ সাহস দিয়েছেন। তাতে আমার মনে হয়েছে, ভালো জায়গায় বল করতে পারলে ভালো কিছু হতে পারে। আমি শুধু ভালো জায়গায় বল করতে চেয়েছি। তাতেই হয়ে গেছে।’

ঢাকারই অদূরে সাভারের বলিয়ারপুরে বেড়ে উঠা আলিস নিজের ক্রিকেটার জীবনের গল্প শুনিয়ে বলেন, ‘আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করি কলা বাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট ক্লাবের হয়ে। এরপর কয়েক বছর সেকেন্ড ডিভিশনে খেলার পর ফাস্ট ডিভিশনে খেলেছি। এরপর এই বিপিএল।’

আর সেই বিপিএলের প্রথম ম্যাচই তাকে জিরো থেকে বানিয়ে দিল হিরো।