নিজেদের জন্যই শেখ হাসিনাকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র

সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই চলছে। এতে দুই দেশের সাধারণ স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন উপকারী সহযোগী হিসেবেই মনে করে ওয়াশিংটন।

এসব মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক উড্রো উলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান। বাংলাদেশের নির্বাচন, নির্বাচন পরবর্তী ওয়াশিংটন-ঢাকার সম্পর্ক ও স্বার্থ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপির সঙ্গে।

বিশ্বের অষ্টম জনবহুল ও মডারেট মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতাকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তবে সেরকম ঘনিষ্ঠ নয়।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তবে বিরোধীরা তার এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।

পর্যবেক্ষকদের বাংলাদেশে যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে নির্বাচনের আগে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের জন্য বৃহত্তর প্রচেষ্টা নিশ্চিতের আহ্বান জানায় দেশটি। কিন্তু নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা কামনা করে একটি চিঠি লেখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চিঠিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্নবায়নের আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামি ইস্যুতে অত্যন্ত কঠোর শেখ হাসিনা। এই দলটির পাঁচ নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এছাড়া প্রতিবেশি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন বাংলাদেশের এ প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ অভিযান বলে মন্তব্য করেছে। এই সঙ্কটকে আঞ্চলিক সঙ্কটে পরিণত না করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে একজন উপকারী অংশীদার হিসেবে দেখছে। সন্ত্রাসের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর। তার নেতৃত্বে তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।’

‘বাংলাদেশ কার্যকরভাবে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। তবে দেশটির পরিস্থিতি মূলত ওয়াশিংটনের সঙ্গে খাপ খায়। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার একজন সমর্থক ও চর্চাকারী হিসেবে ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।’

বৃহৎ পরিসরে সম্পর্ক চায় যুক্তরাষ্ট্র

নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগকে গুরুতরভাবে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিবৃতি ছিল হতাশাজনক। এই বিবৃতির জন্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় সমর্থকদের দায়ী করেছেন তিনি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করে জয় বলেছেন, বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণই অগ্রাধিকার পাবে। আমাদের বিশাল ভোক্তা বাজার রয়েছে। এখানে প্রায় ৮ কোটি মধ্যবিত্ত মানুষ রয়েছেন।

সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্বের অল্প যে কয়েকটি সন্ত্রাসমুক্ত মুসলিম দেশ রয়েছে বাংলাদেশকে সেগুলোর একটি হিসেবে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালীন দূরবস্থার আলোকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সরকার প্রকৃত সহানুভূতি অনুভব করেছিল। তবে ইউরোপে অভিবাসীরা যে ধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, এখানে সে ধরনের পরিস্থিতি হয়নি।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। মার্কিন বান্ধব ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল তৈরির যে লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে এটিও তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কায় চীনের ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছেন চীন। তবে উচ্চ অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো চুক্তি করেনি বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি স্পর্শকাতর ফ্যাক্টর হচ্ছে প্রতিবেশি, আঞ্চলিক শক্তি ও ওয়াশিংটনের অন্যতম মিত্র ভারত। এই দেশটি শেখ হাসিনাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটনের সুযোগ সীমিত। তবে বিরোধীরা আশাবাদী যে, যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মুখেও পড়তে পারে বাংলাদেশ।

বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সেক্রেটারি হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এটা পরিষ্কার করা উচিত যে, যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করবে ওয়াশিংটন।