নিধনযজ্ঞের ৯ মাস : স্বপ্নহীন রোহিঙ্গাদের চোখে অন্ধকার

তাদের ঘরগুলো প্রায়ই প্লাস্টিকের শিটে তৈরি। তাদের খাবারের অনেকাংশই আসে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। কাজ নেই বললেই চলে, বেদনাদায়ক হলেও কিছুই করতে পারছে না। দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিরামহীন।

ভয়াবহ নৃশংসতা শুরুর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে আজ (২৫ ফেব্রুয়ারি)। যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছেন বাংলাদেশে; তারা এখন সান্ত্বনা খুঁজছেন।

‘কেউ আমাদের খুন করতে আসছে না, এটা সত্যি’- বলেন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ। গত বছর রাখাইনে তার গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পরে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়েছেন। বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে এ রোহিঙ্গা পরিবার। আমানুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এখানে শান্তিতে আছি।’

গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কয়েকটি তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা; এতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়।

হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট ও রক্তাক্ত অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। এসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, নারী ও তরুণীদের ধর্ষণ, ঘর-বাড়ি ও সব গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইথআউট বর্ডারস বলছে, সহিংসতা শুরুর প্রথম মাসেই অন্তত ৬ হাজার ৭০ রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৩০ শিশু রয়েছে; যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। নিপীড়নে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশের পথে।

ছয় মাস পর রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরার সামান্য আলামত দেখা যাচ্ছে। যেকোনো সময় তারা ফিরে যেতে পারেন। নিরাপদে, নিরাপত্তায় ও মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ধারাবাহিকভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয় এবং ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে।

স্যাটেলাইটে ধারণকৃত রাখাইনের নতুন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের গ্রাম ও বাড়ি-ঘরে বুলডোজার চালিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জীবন-যাপনের অতীত সব আলামত মুছে ফেলা হচ্ছে। গত আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার থেকে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। আরো অনেক রোহিঙ্গা এখনো পালাচ্ছেন। সীমান্তে অনেকে অপেক্ষা করছেন।

আমানুল্লাহর প্রশ্ন, ‘তারা যদি আমাদের ফেরত পাঠাতে রাজি হয়, তাহলে ঠিক আছে, তবে এটা কি সহজ?’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে। সেটা আমাদের বাড়ি। নাগরিকত্ব দেয়া না হলে তারা আবারো আমাদের ওপর নিপীড়ন চালাবে। তারা আমাদের আবারো হত্যা করবে।’

কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে ফিরতে চান। সেখানে আমাদের দেখাশোনা করতে হবে তাদের (জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের)। অন্যথায় এতে কোনো ভালো ফল আসবে না।’

বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার সেদেশের জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে না রোহিঙ্গাদের। দশকের পর দশক ধরে তারা দেশটিতে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুরা অত্যন্ত কঠিন সময়ের মুখে পড়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, শিবিরে আশ্রিত ৫ হাজার ৬০০ পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এই শিশুরা।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্ক পায়ার্স এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রাখাইনে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে রোহিঙ্গা শিশুরা তা তারা ভুলতে পারবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। শরণার্থী শিবিরেও তারা আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

পায়ার্স বলেছেন, ‘শিশুদের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার এই বার্তা বলছে, তারা ভীত। একজন শিশুর বেঁচে থাকার জন্য এটা কোনো উপায় নয়।’

এই পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এপ্রিলে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের সময় শরণার্থীদের প্ল্যাস্টিক ও বাঁশের তৈরি শিবিরে বিপর্যয় শুরু হবে।

সূত্র : এপি।