নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া

আগামি ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং সীমানা নির্ধারণ কাজে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর অংশ হিসাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অভিযোগ দাখিলের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে অনলাইনে মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার বিধান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইসির আইসিটি অণুবিভাগের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, অনলাইনে মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পোর্টাল থাকবে। এটি হলে মনোনয়নপত্র বাছাইসহ অন্যান্য কাজ নির্ধারিত সময়ে ও নির্ভুলভাবে করা যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন- নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সহজ ও স্বচ্ছ করার জন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চায় কমিশন। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো গতকাল নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে তোলা হয়। তবে কমিশন প্রস্তাবগুলো কারিগরি কমিটিতে পাঠিয়েছে। কমিটি যাচাই বাছাই করে পরবর্তীতে আবার কমিশনে প্রস্তাব পাঠাবে। কমিশন প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করলে আগামী নির্বাচনে বাস্তবায়ন করা হবে।

ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগাতে সক্রিয় বর্তমান কমিশন। এজন্য জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) প্রযুক্তি ব্যবহার করে সীমানা পুন:নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা এবং ইসির নিজস্ব ওয়েবসাইট আধুনিকায়ন করা হবে। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা যাবে।

অনলাইনে মনোনয়ন সংক্রান্ত ইসি সচিবালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে- নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রার্থীরা নানা ধরনের অভিযোগ করেন। অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে অভিযোগকারী সঠিক সময়ে অভিযোগ দিতে পারেন না। আবার অনেক সময় অভিযোগ সম্পর্কে ইসির উচ্চ পর্যায় জানতে পারেন না। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অনলাইনে অভিযোগ দাখিলের ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে নিজের নাম ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন করা যাবে। এই একাউন্ট থেকে অভিযোগ বা পরামর্শ দেয়ার সুযোগ থাকবে। পরবর্তীতে অভিযোগকারী নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে পারবেন।

ইসির আইসিটি অণুবিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল হক স্বাক্ষরিত তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় তিনটি খাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, অফিস অটোমেশন সিস্টেম ও ওয়েবসাইট আধুনিকায়ন।

সীমানা পুন:নির্ধারণ কাজে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে প্রস্তবনায় বলা হয়েছে, ওয়েব বেইজড জিআইএস টুল ব্যবহারের মাধ্যমে জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাবে। এই টুলে উপজেলা, ইউনিয়ন, মৌজাসহ প্রয়োজনীয় সকল ধরনের তথ্য সংযোজন করলে ম্যাপ আপডেট করা যাবে। একইসঙ্গে জিও ইনফরমেশন সংযোজন করা হলে সীমানা নির্ধারণ ও ভোটকেন্দ্র নির্বাচন করা যাবে। নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, নির্বাচনে প্রার্থীরা নির্দিষ্ট ওয়েব পোর্টালে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র নির্ভুলভাবে বাছাই করতে পারবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।

জাতীয় নির্বাচনে

অনলাইনে মনোনয়নপত্র

দাখিলের পরিকল্পনা

নির্বাচন মনিটরিং ও ভোটগ্রহণের যেসব ঝুঁকি রয়েছে তা জানা যাবে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে। এ বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে ইসির মনিটরিং টীম ফোন করে তথ্য সংগ্রহ করে যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক্ষত্রে প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে মোবাইলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শর্টকোড ব্যবহার করে প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা সরাসরি ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে জানাতে পারবেন। এছাড়া নির্বাচন কমিশন ও ইসির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সারাদেশের নির্বাচনি কার্যক্রম অনলাইনে সরাসরি দেখতে পাবেন। এছাড়া নির্বাচনের ফলাফল তাৎক্ষনিকভাবে ওয়েবাসইটে প্রকাশের বিষয়ে সফটওয়ারে ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় দেখা গেছে- নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ করে থাকেন প্রার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে সঠিক সময়ে অভিযোগ করতে পারেন না তারা। এক্ষেত্রে কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে অভিযোগ করা যাবে। এক্ষেত্রে নিজের নাম ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে একটি একাউন্ট খুলে যেকোনো অভিযোগ, মতামত ও পরামর্শ ইসিকে দিতে পারবেন প্রার্থীরা। অনলাইনে দাখিল করা যেকোনো অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজ একাউন্ট থেকে দেখতে পারবেন এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এছাড়া নির্বাচনী কাজে ব্যবহƒত মালামাল ব্যবস্থাপনা এবং বাজেট বরাদ্দকরণ ও ব্যয় সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য পৃথক সফটওয়্যার তৈরির কথা বলা হয়েছে এ প্রস্তাবে।

পর্যবেক্ষনও অনলাইনে :
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও অনলাইন ভিত্তিক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখন ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটি সময় সাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মোবাইল ফোন থেকে ইসি সচিবালয়ের জন্য নির্ধারিত শর্টকোডে এসএমএসের মাধ্যমে কেন্দ্রের অবস্থা জানাতে পারবেন। ইসির সার্ভারে ম্যাসেজগুলো জমা হবে। ইসি ও সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সারা দেশের নির্বাচনী কার্যক্রম অনলাইনে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবেন।

অফিস অটোমেশন সিস্টেম :
নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে এ প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এর আওতায় ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোতে স্থায়ি ও অস্থায়ি সম্পদের ব্যবস্থাপনা, গাড়ি ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য কার্যক্রম দ্রুত করার জন্য পৃথক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রস্তব করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিরাপত্তা ও আগতদের তথ্য ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা, কেন্দ্রীয়ভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ও তা মনিটরিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রশিক্ষণ, ভোটার তথ্য যাচাই কার্যক্রম এবং কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন ডিজিটাল ফরমে মেটাডাটাসহ গোপনীয়ভাবে সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওয়েবসাইট হালনাগাদ :
ইসির ওয়েবসাইট হালনাগাদ করে কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকানা ও ফোন নম্বর ওয়েবসাইটে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনি ফলাফল, গেজেট, নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এ ওয়েবসাইটে সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে ব্যবহারকারী বেড়ে যাওয়ায় ওয়েবসাইট যাতে গতিহীন না হয়ে যায় সেজন্য সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। হ্যাকিং ঠেকাতে ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানান- ওই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনী কার্যক্রম আরও গতিশীল ও স্বচ্ছ হবে। বিদ্যমান ইসির নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসবে। প্রার্থীরাও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ পাবেন। এমনকি অনলাইনের মাধ্যমে নির্বাচনী অভিযোগ বা মতামত ও পরামর্শ দাখিল ও এর প্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো সে বিষয়ে জানতে পারবেন।