নির্বাচনে এই ইভিএমে কারচুপি অসম্ভব : ইসি বিশেষজ্ঞ

নির্বাচন কমিশন যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম কিনতে যাচ্ছে, সেগুলো বাংলাদেশে নির্বাচনের সব ধরনের কারচুপি বিবেচনায় রেখেই তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হায়দার আলী।

এই বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যযন্ত কমিশনের আইডিয়া প্রকল্পের সদস্য ছিলেন। এই কমিটিই সে সময় আঙ্গুলের ছাপসহ জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। পরে স্মাট কার্ড প্রকল্পে কাজ করতে করতে এই ইভিএম প্রকল্পে যুক্ত হন তিনি।

নির্বাচনের সনাতন পদ্ধতির বদলে ইভিএমে ভোট নিতে আগ্রহী নির্বাচন কমিশন ও সরকার। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই যন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে না। যদিও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হচ্ছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর তিন হাজার একনেক অনুমোদন করে ১৮ সেপ্টেম্বর তিন হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক।

এই ইভিএম কেনা হবে সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে। প্রতিটি যন্ত্রের দাম পড়ছে দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধী। তাদের দাবি এই যন্ত্র দিয়ে দূর থেকে ভোট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদিও ইসি কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক হায়দার বলছেন, এর কোনো সুযোগই নাই।

বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের চেষ্টা হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনের আমলে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে এই ইভিএম ব্যবহার করা হয়।

পরে কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কমিশন ২০১২ সালে কুমিল্লায় এবং ২০১৩ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে। এই যন্ত্রটি তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট। কিন্তু সেই যন্ত্রে কিছু সমস্যা ছিল।

তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেসব যন্ত্র ব্যবহার করছে, তাতে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। ইসি কারিগরি কমিটির বিশেষজ্ঞ হায়দার আলী বলেন, ‘আগের ইভিএমের চেয়ে এর পার্থক্য হলো ‘বায়োমেট্রিক অথিনটিফিকেশন’। এটা নির্ভুল আর তা প্রমাণ হয়েছে বিভিন্ন ভাবে।’

‘এই ইভিএমে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে আইডিন্টিফিকেশন করা হয়েছে। ভোটার নিজে না আসলে ভোট দিতে পারবে না। আবার অনেক দেশে অনলাইন ব্যবস্থা আছে। আমরা এটা কমপ্লিটলি অফলাইন করেছি। আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে না বলে এটি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’

এই ইভিএমের উদ্ভাবক হলেন সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন। হায়দার আলী বলেন, ‘একটা ভোট কেন্দ্রে সম্ভাব্য যতগুলো অনিয়ম হতে পারে তার সবগুলো যেন মোকবেলা করতে পারে সেই বিবেচনা করেই মেশিনটা বানানো হয়েছে।’

এই ইভিএমে আগে থেকেই কোনো দলের ভোট সংখ্যা কমান্ড দিয়ে রাখা যায় বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যে সন্দেহ, তারও জবাব দিয়েছেন ইসির এই বিশেষজ্ঞ।

বলেন, ‘এটা যদি সম্ভব হয় তা হলে প্রচলিত পদ্ধতিতেই সম্ভব। ধরুন পেশিশক্তি ব্যবহার করে একটা কেন্দ্র দখল করে নিল। অথবা একটা বুথ দখল করে নিল। নিয়ে একশ পেইজের একটা ব্যলট পেপারে কয়েক মিনিট লাগবে সিল মারতে। এটা আমরা ঠেকানোর ব্যবস্থা করেছি।’

‘ভোট কেন্দ্র দখলও করে সব এজেন্ট বের করে দিলেও একটা ভোটও দিতে পারবে না। কারণ, ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে অথিন্টিফিকেশন করালেই সেটা সম্ভব। এটা অবশ্য জোর করে কাউকে দিয়ে করা যাবে। কিন্তু ভেবে দেখুন, এভাবে একশ লোককে ধরে আনা কি সম্ভব?’

হায়দার আলী জানান, ইভিএম বাংলাদেশে তৈরি হলেও এটি নির্মাণে হার্ডওয়্যার আনা হচ্ছে চীন থেকে। আর এটি সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কোম্পানি ‘অ্যাপেল’। বিদ্যুৎ ছাড়াও মেশিনটার ব্যাটারি ৪৮ ঘণ্টা টানা চলতে পারবে।

‘আস্থা আনতে তিন পরামর্শ’

ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির সন্দেহ সংশয় দূর করার একটি পন্থাও বাতলে দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন দেশের ও দেশের বাইরের হ্যাকারদের আমন্ত্রণ জানাতে পারে।

‘কমিশন বলতে পারে, হ্যাকিংয়ের জন্য পুরষ্কারও ঘোষণা করতে পারে। যে কেউ যদি এই মেশিনে ফেইক আইডিন্টিফিকেশনে ভোট দিতে পারে, তাহলে তাকে পুরষ্কার দেয়া হবে। তাহলে এই মেশিন কতটা শক্তিশালী সেটা প্রমাণিত হবে। এতে মানুষের ভেতরে আস্থা বাড়বে।’

‘কমিশন প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ করতে পারে। তারা কারিগরি লোক নিয়ে আসেন এনে দেখুন আমাদের মেশিনে কোন ভুল আছে কি না। কোন দুর্বল পয়েন্ট আছে কি না।’

অধ্যাপক হায়দার বলেন, ‘আমরা যে ডিজাইন খুঁজে বের করেছি, আমি নিশ্চিত এর মধ্যে কোন ভুল খুঁজে পাবে না। কোনোভাবে ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে অথেন্টিক মানুষ ছাড়া কোনভাবে ভোট দিতে পারবে না।’

ভোটারদেরকে ইভিএমের সঙ্গে পরিচিত করার পরামর্শও দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। বলেন, ‘কমিশন যত দ্রুত এটার প্রচারণা করতে পারে সেটাই ভালো হবে। শুধু পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশনেই না, ভোটারাদের সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করা উচিত। ফেইক ভোট দিতে পারে কি না-সেই সুযোগ তাদেরকেও দেয়া উচিত। তাহলেই আস্থা তৈরি হবে।’

নিরক্ষরদের এই যন্ত্র ব্যবহারে কোনো সমস্যা হবে না বলেও মনে করেন অধ্যাপক হায়দার। বলেন, ‘মানুষ পড়ালেখা না করেও ইংরেজি বাটনের মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। মানুষ তো এটুকু শিখে ফেলেছে। এখানেও কিছু বাটনে চাপ দেয়ার বিষয় আছে। এটুকু কেন তারা শিখতে পারবে না?