পদদলিত হয়ে ১০ নারীর মৃত্যু

নিহত পরিবারকে ৩ লাখ ও কর্মক্ষম ব্যক্তিকে চাকরির ঘোষণা

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি মাদ্রাসা মাঠে ইফতারসামগ্রী আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছেন ১০ নারী। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন।

সোমবার সকালে উপজেলার পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গা মঈনুল উলুম কাদেরীয়া মাদ্রাসা মাঠে হুড়োহুড়ি করে ইফতারসামগ্রী নিতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে। কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের (কেএসআরএম) পক্ষ থেকে এসব ইফতারসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছিল। বিতরণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কেএসআরএমের পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কেএসআরএমের পরিচালক শাহরিয়ার জাহান কোম্পানির পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা এবং অসুস্থদের জন্য সার্বিক চিকিৎসা খরচ বহন করা হবে। এ ছাড়া নিহতদের পরিবারের চাকরি করতে সক্ষম সদস্য থাকলে তাদের চাকরি দেয়া হবে।

পদদলিত হয়ে নিহতরা হলেন, খাগরিয়ার মো. ইসমাইলের স্ত্রী হাসিনা আক্তার, দক্ষিণ ঢেমশা রাস্তার মাথা এলাকার মো. হাসানের স্ত্রী রিনা বেগম, উত্তর ঢেমশা মাইজপাড়া এলাকার আবুল কালামের স্ত্রী সাকি, খাগরিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজনপাড়া এলাকার নূর হোসেনের স্ত্রী রশিদা আকতার, লোহাগাড়ার কলাউজান ২ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুস সালামের মেয়ে টুনটুনি বেগম, লোহাগাড়ার কলাউজান ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রসুলাবাদ এলাকার আবদুল হাফেজের স্ত্রী জ্যোস্না আকতার, লোহাগাড়ার উত্তর কলাউজান এলাকার আলাউদ্দিনের মেয়ে নূর জাহান, চন্দনাইশের পূর্ব দোহাজারী এলাকার মৃত নূর ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও বান্দরবানের সুয়ালক ২ নম্বর ওয়ার্ডের কায়স্থলী এলাকার মো. ইব্রাহীমের স্ত্রী নূর আয়শা।

এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে সহসা রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের মালিক পক্ষ প্রতিবছরই এলাকায় হতদরিদ্রদের মাঝে ইফতার ও ঈদসামগ্রী বিতরণ করে থাকে। এবারও অন্তত ২০ হাজার মানুষের মাঝে ইফতারসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইফতার দেয়ার জন্য বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন কেএসআরএমের মালিতক মোহাম্মদ শাহজাহানও। প্রতিবছর মালিকের উঠোনে ইফতারসামগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা করা হলেও এবার মাদ্রাসা মাঠে বিশাল শামিয়ানা টানিয়ে ইফতার প্রদানের আয়োজন করা হয়। দরিদ্রদের মাঝে ইফতার ও ঈদসামগ্রী বিতরণ করা হবে এ খবর দুয়েক দিন আগে থেকেই প্রচার হতে থাকে।

সোমবার ইফতারসামগ্রী বিতরণের নির্ধারিত দিন থাকলেও রোববার রাত থেকেই সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবান থেকেও হতদরিদ্র লোকজন মাদ্রাসা মাঠে জড়ো হতে থাকে। ওই মাঠে ১০ হাজার ধারণক্ষমতা থাকলেও অন্তত ২০ হাজার নর-নারী জড়ো হয় ইফতারসামগ্রীর জন্য। কবির স্টিলের পক্ষ থেকে ২০ হাজার হতদরিদ্র পরিবারে ইফতারসামগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, চনা, মসুর ডাল, একটি শাড়ি ও নগদ এক হাজার টাকা। ইফতারসামগ্রী বিতরণের জন্য ১০০ এর মতো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়। ছিল থানা পুলিশের বেশকিছু সদস্যও। লাইনে দাঁড় করিয়ে সবাইকে ইফতারসামগ্রী প্রদান করা হচ্ছিল। একপর্যায়ে কার আগে কে ইফতারসামগ্রীর প্যাকেট নেবে এই প্রতিযোগিতা শুরু হলে পদদলনের ঘটনা ঘটে। একজনের ওপর দিয়ে চলে যায় শতজন। পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ৯ নারী। একজন হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। এ ছাড়া আরও অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। যাদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিজিসি ট্রাস্ট হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এদিকে ঘটনার পরপর যান জেলা স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধারকাজ মনিটরিং করেন।

ঘটনাটিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটিকে সহসা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির তদন্তে কারও অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে এমন বিষয় প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, যে পরিমাণ মানুষকে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয় ঠিক সে অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক ছিল না বলে তারা জানতে পেরেছেন।

অন্যদিকে স্থানীয় নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তছলিমা আবছার বলেন, যাদের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের স্বজনপ্রীতি অর্থাৎ নিজেদের চেনাজানা লোকদের আগে ইফতারসামগ্রী দিতে গিয়ে ও মিস ম্যানেজমেন্টের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন। ২০ হাজার লোককে ইফতারসামগ্রী দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন ঘটনা ঘটে তখন অর্ধেক লোককেও ইফতারসামগ্রী দেয়া যায়নি।