নুসরাত হত্যা: এবার ফেঁসে যাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কারাগার থেকে নানা দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন অধ্যক্ষ সিরাজ- উদ-দৌলা। সে মোতাবেক রাফীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এমনটি আদালতে আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। এদিকে কারাবিধি লঙ্ঘন করে আলোচিত আসামি সিরাজের সঙ্গে তার অনুসারীদের একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ করে দেওয়ায় এবার কারা কর্তৃপক্ষ ফেঁসে যেতে পারে বলে পিবিআই সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাফী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম ১৬৪ ধারায় ১৫ এপ্রিল রোববার ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিয়েছে। দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা ধরে এই জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নুর উদ্দিন ও শামীম পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে।

জবানবন্দিতে নুর উদ্দিন জানায়, ৩ ও ৪ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে ফেনী কারাগারে দেখা করে সে, শামীম, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন। তারা ‘আলেম সমাজকে হেয় করায় সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে নুসরাতকে ‘একটা কঠিন সাজা দেওয়া’র ব্যাপারে হুকুম চায়। ওই সময় শামীম নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব দেয়। তখন এ প্রস্তাবে সায় দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা তাদের নির্দেশ দেয়, ‘কর। তোমরা কিছু একটা কর।’ একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলা এ নিয়ে ‘বেশ কিছু গোপন টিপস’ দেয় বলে জবাবন্দিতে উল্লেখ করে নুর উদ্দিন।

নুর উদ্দিন আরও জানায়, সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশনা পাওয়ার পর ৫ এপ্রিল সে, শামীম, জাবেদ হোসেন ও হাফেজ আবদুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন মাদ্রাসার পাশের পশ্চিম হোস্টেলে বৈঠকে বসে। সেই বৈঠকে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যা ৬ এপ্রিল তারা বাস্তবায়ন করে।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাহদাত হোসেন শামীম বলেছে, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা শুরুর আগে তারা মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে থাকা টয়লেটে ওৎ পেতে থাকে। এর আগে এক নারী সহযোগীকে দিয়ে তারা তিনটি বোরকা ও কেরোসিনের ব্যবস্থা করে। আলিম পরীক্ষা শুরুর আগে তারা উম্মে সুলতানা পপিকে দিয়ে কৌশলে নুসরাতকে ছাদে নিয়ে আসে। এরপর নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে জবানবন্দিতে শামীম জানিয়েছে।

এ ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন জড়িত থাকার কথা উঠে আসে। ফলে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সোনাগাজী তাকিয়া রোডের বাসভবন থেকে রুহুল আমিনকে আটক করে পিবিআই। পরদিন শনিবার বিকালে আদালতে গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

কারাগারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, কারাবিধি অনুযায়ী আলোচিত আসামির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের সময় একজন কারারক্ষী বা কারা কর্তৃপক্ষের যে কেউ উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে নুর উদ্দিন ও শামীমের একান্ত সাক্ষাতের সময় কেউ উপস্থিত ছিল না। ফলে দীর্ঘ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে কথপোকথন। এ সময় রাফেিক হত্যা করার ব্যাপারে সিরাজ-উদ-দৌলা তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। যদি কারা কর্তৃপক্ষের কেউ উপস্থিত থাকত তাহলে রাফীকে হত্যার পরিকল্পনা জানতে পারত। ফলে তাকে পুড়িয়ে মারার মতো এমন ঘটনা হতো না বলেও ওই সূত্র দাবি করে।

পিবিআইর একটি সূত্র জানিয়েছেন, এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

রাফীর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, রাফীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনিটরিং করছেন। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি আইনজীবী জানিয়েছেন, কারাগার থেকে সিরাজের নির্দেশে রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় বিধি লঙ্ঘন করায় কারা কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি জানান তিনি।

ফেনী কারাগারের জেলার দিদারুল আলম জানান, এ ব্যাপারে আমি কোনো তথ্য দিতে পারব না। কোনো তথ্য নিতে হলে আইনের আলোকে জেল সুপার বরাবর আবেদন করতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে পিবিআই প্রধান বনজ কান্তি মজুমদার জানিয়েছেন, এ মামলায় এজাহারভুক্ত ৮ আসামিসহ মোট ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুর রহিম শরিফ, হাফেজ আবদুল কাদের, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন্নাহার মনি, জাবেদ হোসেন ও জোবায়ের আহাম্মদ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা ৮ জনই রাফী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।

এর আগে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নুসরাত জাহান রাফীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় রাফীর পরিবার সিরাজকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় সিরাজ কারাগারে থাকাকালীন তার অনুসারীরা মামলা তুলে নিতে রাফীর পরিবারকে হুমকি দেন।

৬ এপ্রিল সকালে মাদ্রাসার ছাদে ঢেকে নিয়ে রাফীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় মুখোশধারীরা। টানা পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল বুধবার রাত ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফী। পরদিন সকালে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দিলে বিকালে সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।