পথটি মন্দ হলেও ভালবাসার যোগ্য | শাম্মী তুলতুল

মূখটা তুলতেই দেখি ক্লাসের বাইরে দাঁড়ানো তুলি। কেউ যদি উচ্চস্বরে স্যার, স্যার বলে ডাকে স্বাভাবিকভাবে ধাক্কা লাগে। ফলে ক্লাসের মাঝখানে বিরক্তি, রাগ ছুঁয়ে যায়। পর-পর দুটি ক্লাস; তাও আবার এমন কোনো ছাত্রীর আচরণ।

রেগে কিছু বলতে যাব এমন সময় তুলি বলে, স্যার না বলে কয়ে ঢুকে পড়লাম। রাস্তার যা হাল গাড়ী বরে করা মহা সমস্যা । তার উপর জ্যাম। আরো বড় সমস্যা হল বড় রাস্তাগুলো ভয়ে এপার থেকে ওপারে পাড় হতে পারি না। ১০ টাকা দিয়ে রিক্সায় চড়ে রাস্তা পাড় হই।

কথার সঙ্গে ওর টোল পড়া মিষ্টি হাসি, আর চঞ্চল চোখ দুটোর উঠানামা দেখলেই রাগটা হজম হয়ে যায়। একটা দিনও মেয়েটি ক্লাস ফাকি দেয় না। খুবই মনোযোগী, দেরীতে আসা একটু স্বভাব আর যত বাহানা।
তুলির কথা ভাবতে ভাবতইে চরম বিরক্তকর নিধন বাবুর আগমন,
উকিল বাবু আছনে , নাকি ব্যস্ত ?
কিছু বলবেন?

একটু কথা ছিল।
একটু অপেক্ষা করুন; ছাত্রদের বিদায় করি।
পান চিবুতে-চিবুতে সায় দিয়ে একটু দূরে বেঞ্চে গিয়ে বসলনে তিনি।

চাইলেই ছাত্রদের সামনে কথা সেড়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু উনি অল্প কথার লোক নন। এলোমেলো কথা বেশি বলেন। তখন কান বন্ধ করার উপক্রম হয়। বীনা ম্যাডাম কেমন ব্লাউজ পরে আজ এসেছেন, গলাটা বেশি নিচে নেমে গেছে, কোন বয়সে কি পড়া দরকার, এভাবে ঘোমটা দিলে কি হয়, ওভাবে দিলে কেমন হয়।হিজাবটা দেওয়া না দেওয়া সমান। এমন কিছু অপ্রয়োজনীয় কথার কারণে তিনি সবার কাছে অপ্রিয় একজন স্যার। সময়মতো নিধনবাবুকে সামনে আসতে বললাম। মুখের ভিতরের আবর্জনাগুলো ফেলে ভূড়িটা সামনে এলিয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন।

এবার বলুন আজ কি ব্যাপারে কথা বলবনে ? একটু চুপ করে রইলেন। সবসময় যা করেন।একটু গলা ঝেড়ে নিলেন । কাশিটা প্রতবিারে ভদ্রতার লক্ষণ মনে হয়।

নিধনবাবু বললেন, নাম মিতু, বয়স ৩২, তোমার বুক সমান হবে। দিন-দিন ভালবাসা বাড়ছে তার। যখন তখন বারান্দায় উকি দেয়। ও রাজী । কিন্তু ভয় পাচ্ছে আপনাকে বলত।তাই আমি ব্যাপারটা বলতে এলাম । এটা তো একটা ছওয়াবরে কাজ। কি বলনে?
কি বলছেন এসব,কিছুইতো বুঝতে পারছিনা নিধনন বাবু ?

ইয়ে মানে, আসলে আপনি রাজী কিনা? মিতু জানতে চেয়েছে?

নিধনবাবুর কথা শুনে আমার আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। সেই বিদ্যুৎ গায়ের উপর এসে পড়ল মনে হল।
আপনারতো কেউ নেই; একটা মাত্র মেয়ে। সব গুছিয়ে নিতে পারবে ও, একেবারে পরিচ্ছন্ন একটা মেয়ে।তাই সম্বন্ধটা আমাকে দিয়ে সরাসরি পাঠালেন ।

আমিতো অবাক, মিথিলা, ফর্সা চেহেরা, বয়স একত্রিশ কি বত্রিশ। থাকে আমার পাশের ফ্ল্যাটে। বাপ, মেয়ে দুজনের সংসার, স্কুলের টিচার। কিন্তু সে কখোন, কিভাবে তার চলমান জীবন যাপনে আমার জন্য জায়গা করে নিল। আমি কোনদিন টেরই পেলাম না। আমি প্রানপন চেষ্টা করছি, নিধন বাবুর কথার ডায়রী থেকে সরে আসতে। তাছাড়া এতসব র্অথহীন কথা শোনার মত বাড়তি সময়ও আমার নেই। যেমন তেমন বলে নিধনবাবুকে বিদায় করলাম। নিধনবাবু চলে যাওয়ার পর শুধু একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মেয়েটি আচ্ছা বোকাতো, নিধনবাবুকে দিয়ে সম্বোন্ধ পাঠিয়ে দিল। এসব ভাবনায় যখন মত্ত তখন উকিল বাবু ফিরে গেলেন সেই হৃদয় বিদারক অতীতে । যে অতীত তিনি ভুল করেও ভুলতে চাননা।

কি গো আজ তো বাইরে খাওয়ার কথা। ৫ বছর পাড় হয়ে গলে। ৫ম ববিাহ র্বাষকিী আজ আমাদের। আজকে একটু তাড়াতাড়ি এসো । সেই কখোন থেকে মা – মেয়ে তৈরি।

বললাম, একটা কাজ করো তুমি মেয়েকে নিয়ে সোজা রস্টেুরন্টে এ চলে এসো।আমি তোমাদের আগইে হাজীর হচ্ছি।
ফোনটা রেখে অপেক্ষা। অনকেক্ষণ পর রিতা এলো। যখনি রিতা রাস্তা ওপাড় থেকে এপাড়ে পাড় হচ্ছিল ঠিক তখনই একটি চারচাকা আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে গেলো। সব শষে করে দিয়ে চলে গলে। মুর্হূতইে চোখের সামনে রাস্তাটি ভয়ানক হয়ে উঠলো। অনেক দ দিন পাগল প্রায়। মেয়েটির জন্যই সুস্থ জীবনে ফিরে আসা। জানি সে আমার ভেতরে তার মায়ের ছবি খুঁজে বেড়ায় অহর্নিশি। তাই বাকি পথটুকু ওর জীবনটা গড়ার পিছনে কাটিয়ে দিতে চাই । ওর উপর অন্যায় হয়েছে। আমার ভুলের কারণেই ও আজ মা হারা। ওর উপর আর কোন ঝড় যেতে দিবনা । এটই চুরান্ত। ভাবতে ভাবতে বাসায় এসে শরীরটা এলিয়ে দিলেন হাসান সাহেব। এক কাপড়েই একটা ঘুম দিয়ে ফেললেন। ঘুম ভেঙ্গে দেখে জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে এসে পড়ছে । অসহ্য গরমে হঠাৎ বৃষ্টি ভালই লাগে। বৃষ্টি দেখে মনে পড়ে যায় তুলির বৃষ্টি ভেজা পিছন থেকে নিয়ে আসা কাধের এক পাশে বেনীর কথা। কপাল কুচকে মুখে ভেংচী কেটে বৃষ্টিকে তাচ্ছিল্য করা। মাঝে মাঝে শুনি আর মনে মনে হেসে উঠি, টোলপড়া গালে মিষ্টি হেসে বান্ধবীদের ফিস ফিস করে বলতে, আজকে সাদা শার্ট এ স্যারকে অন্যরকম লাগছে।
ভালই লাগে শুনতে। বার বার উকি দেয় সে আমার ভিতর। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান অনেক। বুঝি আমাকে ঘিরে তার দূর্বলতা, নিজেকে উপস্থাপন করার ধরনও। আমার স্বার্থের জন্য ওর জীবনটাকে ২য় করে ফেলতে চাই না। ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়ে। খুব ভাল পরিবারের সে। কথা বলা উচিত ওর সঙ্গে । নইলে স্বপ্ন আরও ঘাড় হতে থাকবে। কয়কেদনি গত হওয়ার পর একদনি ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন হাসান সাহেব । ফেরার পথে তুলিকে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামালো। ভাবল এটাই সুযোগ কথা বলার । গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে গাড়িতে বসতে বলল তুলিকে। তুলি অনেক উৎফুল্ল ছিল। ভাবছে হয়তো ওকে নিয়ে বেড়াতে যাব । ও চট জলদি গাড়িতে বসে পড়ল। অনেক সাহস নিয়ে ওর মনটা ভাঙ্গতে হাতুড়ী নিলো হাসাহ সাহেব। বলে, কিছু বলার ছিল তোমাকে ।
তুলি বলল , জী বলুন।

আসলে যতই দিন যাবে তুমি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে। তাই বলছি জীবনটা নিয়ে খেলোনা, এটা খেলার জিনিস না। জীবন কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তুমি এখোনো দেখনি। আমি এর মাঝে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। মনে করতে চাই সব কিছু অনেক সুন্দর, আনন্দের। কিন্তু ইদানীং বেশিক্ষন পারি না। ক্লান্ত লাগে, অস্থির লাগে । দয়া করো আমাকে। দূরে যাওয়ার চেষ্টা কর ধীরে ধীর। আমি অসহায়। নিরুপায়।

কথাগুলো শুনতেই তুলির চোখ চিক-চিক করে উঠল। উচ্ছসিত চোখ দুটোতে পানরি ঢেউ আসছে আর যাচ্ছে। কিন্তু এতেই তার মঙ্গল। তুলি তরিগরি করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। একটা শব্দও করল না । আমিও আর কিছু বলতে পারলাম না । শান্তনা দেওয়ার মত কোন শব্দও আমার ছিলনা । কিন্তু যায় হোক আমি অনেক সস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম । সারদিন কষ্ট হলেও রাতে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমালাম। পরদিন অফিসে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলাম । আজকের গরমটা মাটি ফাটা, গাড়ির এসিটাও কাজ করছে না। জানালাটা খুলে দিলাম। বাইরে তাকিয়ে থাকলাম । কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হঠাৎ চোখের পলক পড়ল একটা মেয়ের ওপর । বাসের জন্য লম্বা লাইনে দাড়িয়ে। যাত্রীদের সঙ্গে বাসে উঠার জন্য যুদ্ধ করছে । বিশ্রী গালগিালাজ করছে বাসের স্টাফকে । দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। মেয়েটি আর কেউ নয়, তুলি । অবিশ্বাস্য। তার মানে তুলি আমাকে মিথ্যে বলেছিল? বানিয়ে গল্প বলছিল? কিন্তু কেন? এত মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল মেয়েটার ? আমার নিজেরই নিজের কাছে এখন লজ্জা লাগছে। ছোট বড় কোন বিসয় না । সবার উরধে আমরা মানুষ । তার কাছে আমি এটা আশা করনি। উঃ কিছু ভাল লাগছে না। কিন্তু ক্লাসেতো যেতে হবে। তাছাড়া আজ তো অবশ্যই যাওয়া উচিত। তাই নিয়মমত ক্লাসে চলে এলাম । এসে দেখি তুলি আমার আগেই ক্লাসে হাজির। আজ ওকে আগের মতো উচ্ছসিত, হাসি খুশি দেখলাম না। ভীত সন্তস্ত্র। পরীক্ষার হলে নকলে ধরা পড়লে যেমন হয় তেমন। ক্লাস শেষে তুলিকে দাড়াতে বললাম, কিন্তু দাড়ালো না। আমি অনেক অনুরোধ করলাম । তবুও দাঁড়াল না । ও যাতে টের না পায় খুব তাড়াহুড়া করে ওর পিছু নিলাম । কিন্তু পিছু নিয়ে অল্পক্ষণ পর যা দেখলাম নিজ চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না। আর যদি না দেখতাম আমার রাগটাও কমতনা। আজীবন ওকে ভুল বুঝেই যেতাম । দেখলাম মেয়েটি একদল ভক্ষকদের দখলে। প্রতিদিন প্রতিরাত তার আত্মসম্মান, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বলি হয়। তার দেহখানি কেনা- বেচা হয়। তার বের হওয়ার রাস্তা আগুনে সাজানো। যেদিকে যাবে ছাই হবে। যেদিকেই যাবে লোকগুলো তাকে তাড়া করবে । নিঃশ্বাসটাও তাদের মতো করে ফেলতে হবে। এসব দেখে তার মিথ্যেটা আর কোন দোষই মনে হলোনা । কিছু মিথ্যে না হয় তার সন্মান বাঁচাতে কাজে লাগল। কিছু মিথ্যে না হয় তাকে এই নরকে বাস করতে সহায়তা করল। আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু তারপর থেকে তুলিকে আর ক্লাসে দেখতে পেলাম না। হয়তো জানতে পেরেছে। লজ্জার উপরতো কারো দখল নেই। কিন্তু আমার ভিতরটা সে ঠিকই দখল করে নিয়েছে। নতুন করে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য……।