পদত্যাগ করছেন কলকাতার মেয়র, নেপথ্যে পরকীয়া!

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর থেকে পদত্যাগ করছেন কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জী। মঙ্গলবার তার এই পদত্যাগের নেপথ্যে এক নারী অধ্যাপকের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, রাজ্যের দুটি দফতর থেকে পদত্যাগ করেছেন শোভন চ্যাটার্জী। তবে কলকাতার মেয়রের পদ থেকেও তাকে সরে যেতে হতে পারে।

এর পর থেকেই সামাজিক মাধ্যম আর গণমাধ্যমে আলোচনা চলছে; কেন এক সময়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শোভন চ্যাটার্জীকে সরে যেতে বাধ্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মমতা ব্যানার্জীর কাছের লোক ছিলেন এই শোভন চ্যাটার্জী। যাকে নিজের ভাইয়ের মতোই ‘তুই’, ‘তুই’ করে সম্বোধন করতেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি শোভন চ্যাটার্জীর ডাকনাম, কানন বলে ডাকতেন।

অথচ এখন তাকেই মন্ত্রিত্ব আর মেয়রের পদ থেকে সরে যেতে বলা হলো কেন? যে সম্ভাব্য কারণটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে, তা হল বৈশাখী ব্যানার্জী নামে এক অধ্যাপিকার সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক।

আর ওই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েই তিনি যে কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলেন, তা নিয়ে বেশ কয়েকবার মেয়রকে সতর্কও করেছেন মমতা। তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক সূত্র বলছে, বেশ কয়েক মাস আগে একটি দলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তার ‘স্নেহের’ কাননকে বলেছিলেন, ‘তুই প্রেম করবি না-কি কাজ করবি।’

এই প্রেম করা নিয়ে অবশ্য বিশেষ রাখঢাক করেননি কলকাতার মেয়র এবং সদ্য সাবেক-হওয়া আবাসন ও দমকল মন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জী। বৈশাখী ব্যানার্জীকে নিজের ‘ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু’ বলে জনসমক্ষে দ্বিধাহীনভাবে পরিচয় দিয়ে তার ওপরে কোনও আঘাত এলে তা ‘নিজের বুক দিয়ে আগলানোর কথাও’ ঘোষণা দিয়েছিলেন।

নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বছর দেড়েক ধরে স্ত্রী রত্না চ্যাটার্জীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় মেয়রের। তারপরে বিষয়টা গড়ায় বিবাহবিচ্ছেদের মামলায়। তখনই বেহালা অঞ্চলের বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে চলে আসেন তিনি।

ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বৈশাখী ব্যানার্জীর সঙ্গেই সেই ফ্ল্যাটে থাকছেন মেয়র শোভন চ্যাটার্জী। বৈশাখী ব্যানার্জী কলকাতার একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তার স্বামী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশে পরকীয়া সম্পর্ক বেআইনি নয় আর। তাই চ্যাটার্জী যে বেআইনি কিছু করেছেন, তা বলা যাবে না।

মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়ে কাউন্সিলর হয়েছিলেন শোভন চ্যাটার্জী। তারপর থেকেই দ্রুত উত্থান হয় মমতার হাত ধরেই। এরপরে গত প্রায় দু’দশক ধরে মমতার সব আন্দোলনেই নেত্রীর পাশে থেকেছেন শোভন চ্যাটার্জী।

বিবিসি বলছে, ২০১০ সালে যখন আবারও দল কর্পোরেশনের ক্ষমতা দখল করল, তখন থেকেই তিনি মেয়র। একই সঙ্গে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দফতরও তার হাতেই দিয়ে রেখেছিলেন মমতা। কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ার কথাটা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মেয়রের স্ত্রী রত্না চ্যাটার্জীও, যার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে শোভন চ্যাটার্জীর।

তিনি বলছেন, আগে যে মানুষটা সকাল ৮টা – ৯টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত আর ফিরত সেই রাতে, সেই শোভনবাবুই আজকাল কর্পোরেশনে মাঝে মাঝে যান, কম সময় থাকেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষও নিজের এলাকার কাজে মেয়রকে পান না।

একদিকে যেমন বৈশাখী ব্যানার্জীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে নানা গসিপ ছড়িয়েছে মেয়রকে ঘিরে, তেমনই নানা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই দেখা গেছে দুজনকে একসঙ্গে। আবার বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলাকালীনই নিজের কন্যার বিদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র নিতে মেয়র পত্নীকে রাতভর ধর্নায় বসতে হয়েছে মেয়র আর তার বান্ধবী যে ফ্ল্যাটে থাকেন, তার সামনে।

আবার এরই মধ্যে নারদা-নিউজ নামের একটি নিউজ পোর্টালের চালানো স্টিং অপারেশনে মেয়রকে দেখা গেছে এক বান্ডিল টাকা গ্রহণ করতে। ওই ভিডিওটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ঘটনাটা নিয়ে চলছে তদন্তও। তাই নারদা-ঘুষ কাণ্ড বলে পরিচিত ওই মামলায় মেয়রকে দোষী বলা যায় না।

পারিবারিক বিবাদ প্রকাশ্যে এসে যাওয়া এবং অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া আর কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া – এত কিছুর মধ্যেও সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু কালবৈশাখীর মতোই হঠাৎ ঝড়টা উঠল মঙ্গলবার, রাজ্য বিধানসভায়। আবাসন মন্ত্রী হিসাবে এক প্রশ্নের যে জবাব দেন চ্যাটার্জী, তারপরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে সেই তথ্যকে ভুল বলে প্রমাণিত করে অন্য তথ্য দেন। তারপরে এক বৈঠকে কিছুটা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয় দু’জনের মধ্যে।

এরপরের ঘটনা ঘটে রাজ্য সচিবালয় নবান্নে একটি সরকারী অনুষ্ঠান মঞ্চে। শোভন চ্যাটার্জীর দিকে আঙ্গুল তুলে কিছুটা উত্তেজিত ভাবেই কথা বলতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। তারপরে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে চলে যান শোভন চ্যাটার্জী। ক্ষুব্ধ মমতা সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে পাঠিয়ে দেন রাজ্যপালের কাছে।

রাতে তিনি জানান, শোভন চ্যাটার্জী মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। বুধবার তাকে কলকাতা কর্পোরেশন থেকে পদ ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। শোভন চ্যাটার্জীর স্ত্রী রত্না চ্যাটার্জীর মন্তব্য, মমতার কাছে বোধহয় আর কোনও রাস্তা ছিল না। এটাই হওয়ার ছিল।