পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব, রাজবাড়ীতে আতংক!

রাজবাড়ী সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে গত ১৫ দিনে একই কায়দায় তিন নারী ও এক শিশুকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হত্যা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে শত শত পরিবার।

অনেকেই আবার আতঙ্কে নিজ বাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্যত্র আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এর উপরে আবার গুজব রটেছে, পদ্মা সেতুর জন্য রক্ত লাগবে বলে হত্যাকান্ডগুলো ঘটছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত ২ আগস্ট দিবাগত রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের পশ্চিম মূলঘর গ্রামে দাদী শাহিদা বেগম (৪৫) ও নাতনী লামিয়া আক্তারকে (৭) গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত শাহিদা বেগমের শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গিয়েছে।

এ ঘটনার ৫ দিন পর ৭ আগস্ট দিবাগত রাতে বানীবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া গ্রামে নিজ বসত ঘরে দুই সন্তানের জননী আদুরী আক্তার লিমাকে (২৫) এবং সর্বশেষ সবশেষে গত ১৬ আগস্ট রাতে আলীপুর ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামে হাজেরা বেগম (৪৮) নামের এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এই ৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজবাড়ী সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয় এবং পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও কোনো ঘটনারই রহস্য উদঘাটিত হয়নি।

বারবাকপুর গ্রামের গৃহবধূ হালিমা বেগম (৫০) বলেন, পরপর তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারো চোখেই ঘুম নেই। কখন যে কে ঘরে ঢুকে গলা কেটে চলে যায় এই আতঙ্কে ভুগছে সবাই।

তিনি বলেন, আমাদের দাবি- এলাকায় প্রতি রাতে পুলিশের টহলের ব্যবস্থা করা হোক।

সাদীপুর গ্রামের আছমা বেগম (৪৮) বলেন, যাদের বাড়িতে বেশি লোকজন থাকে না, বিশেষ করে পুরুষ মানুষ থাকে না তাদেরকেই গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে। আমার স্বামী মারা গেছে। একমাত্র ছেলে বিদেশে ও মেয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকে। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে আমার বাড়িতে অপরিচিত একজন লোক প্রবেশ করে। তখন আমি ঘরের মধ্যে ছিলাম। পাশের বাড়ির এক মেয়ে ওই লোককে দেখতে পেয়ে চিৎকার দেয়। এ সময় ওই লোক দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। পরে আমি ওই রাতেই বাড়িঘর ফেলে রেখে বসন্তপুর ইউনিয়নে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই।

আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মনোয়ারা বেগম বলেন, আলীপুর, মূলঘর ও বানীবহ ইউনিয়নের অনেক পরিবার হত্যার আতঙ্কে ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘরের মধ্যে এক জায়গায় জড়ো হয়ে নির্ঘুম রাত যাপন করছে। আত্মীয়-স্বজনদের বেড়াতে আসাও বন্ধ হয়ে গেছে।

আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শওকত হাসান বলেন, ঘরে ঢুকে গলা কেটে পরপর কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। আমরা এই শঙ্কার মধ্যে থাকতে চাই না। তাই সবাইকে আরো সতর্ক থাকতে এবং স্ব স্ব এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করছি।

মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ. মান্নান মুসল্লী বলেন, আমার ইউনিয়নের মানুষের মধ্যেও হত্যার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে আমি ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডের সদস্যদের নেতৃত্বে চৌকিদারদের দিয়ে প্রতি রাতে পাহারার ব্যবস্থা করেছি।

রাজবাড়ী সদর থানার ওসি মো. তারিক কামাল বলেন, পশ্চিম মূলঘরে দাদি-নাতনি এবং আটদাপুনিয়ায় গৃহবধূ লিমা হত্যার ঘটনায় আমরা ইতিমধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছি। ওই দুই মামলার অগ্রগতি রয়েছে। এছাড়া বারবাকপুরের গৃহবধূ হাজেরা বেগম হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারেও পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের ফোর্স সংখ্যা কম থাকায় সব জায়গায় টহলের ব্যবস্থা করা সম্ভব না। তবে প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে চৌকিদার দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাজবাড়ী পুলিশ সুপার (এসপি) আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে হত্যাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই হত্যার রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

এসব হত্যাকাণ্ড, আতঙ্ক ও গুজবের বিষয়ে গত শনিবার বিকালে বানীবহ ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গনে আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী বলেন, সাম্প্রতিককালের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল পদ্মা সেতুর জন্য রক্ত লাগার গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। আপনারা এসব গুজবে কান দিবেন না। গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে পুলিশে সোপর্দ করবেন।