পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থান কীভাবে?

বৃহস্পতিবার থেকে ভারতে শুরু হচ্ছে লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। প্রথম দিনেই ভোট নেওয়া হবে পশ্চিমবঙ্গেরও দুটি জেলায়।

পশ্চিমবঙ্গ এক সময়ে বামপন্থীদের দুর্গ বলে পরিচিত ছিল। সেখানে আট বছর ধরে ক্ষমতায় আছে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস দল। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপিও রাজ্যে দ্রুত তাদের ভোট ব্যাঙ্ক বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

দীর্ঘকাল ধরে বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, নবগঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার এরকমই একটা গ্রাম পাটাশিমূল। কলকাতা থেকে মেদিনীপুর হয়ে মুম্বাইয়ের দিকে চলে গেছে যে জাতীয় মহাসড়ক, তা ছেড়ে শাল, পলাশ আর মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে এই গ্রাম।

সেখানে আছেন নয়শোর মতো ভোটার।

ভোটের প্রার্থীদের নাম আর প্রতীক চিহ্ন আঁকা হয়েছে গ্রামের অনেক বাড়ির দেওয়ালেই। কোথাও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর নাম, কোথাও সি পি আই এম আর কোথাও বা বিজেপি প্রার্থীর নাম লেখা আছে দেওয়ালে।

গ্রামের প্রবীণ মানুষ শশাঙ্ক মাহাতোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ।

“আমার বাবা সিপিএম পার্টি করেছেন চিরকাল। যবে থেকে আমার জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে, তবে থেকে আমিও সিপিএম করে এসেছি। কিন্তু গত বছর স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আমরা গ্রামের সবাই সিদ্ধান্ত নিই যে বিজেপি-তে যোগ দেব। ওই ভোটে বিজেপির হয়ে আমরাই পঞ্চায়েত দখল করতে পেরেছি,” বলছিলেন মি. মাহাতো।

সিপিআইএম দল ছেড়ে আরেকটি বামদল সিপিআইতেও গিয়েছিলেন মি. মাহাতো কিছুদিনের জন্য। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে তিনি বিজেপি-তে। গ্রামের অন্য অনেক মানুষের মতোই।

জানতে চেয়েছিলাম, রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা একটা দলে কেন গেলেন? অন্য কোনও দল ছিল না?

তার জবাব ছিল, “কমিউনিস্ট পার্টি তো আমর রক্তে। সেটা তো কোনোদিন যাবে না। কিন্তু শুধু আমি না, গ্রামের সব লোকেই বলেছে, বাঁচতে যদি হয়, তাহলে বিজেপিই করতে হবে। কেন্দ্রে এখন বিজেপি আছে। রাজ্যেও একটা হাওয়া আছে।

সিপিআইএমের স্থানীয় নেতা ছিলেন নটরাজ পাত্র। ১৮ বছর কমিউনিস্ট পার্টি করার পরে গতবছর থেকে তিনি বিজেপি-তে।

“তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে সি পি আই এমের খুব কঠিন সময়েও আমরা পার্টির সঙ্গেই ছিলাম। কিন্তু এটাও ঘটনা, গ্রামের মানুষের একটা অংশ নরেন্দ্র মোদীর হাওয়ার কারণেই হোক বা বিজ্ঞাপনের জন্য হোক, তারা বিজেপি-কে চাইছে। এই সব লোকেদের বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপারটা বোঝানো যাচ্ছিল না। আমরা তাদের সঙ্গে না গেলে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম। সেটা হতে দিতে চাই নি। তাই সবাই মিলেই বিজেপি-র দিকে ঝুঁকেছি আমরা,” – বলছিলেন মি. পাত্র।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, “বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্বের কতটা সম্পর্ক আছে, বা আদৌ আছে কী না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। বিজেপির রাজনীতিটা হল ঘৃণাকেন্দ্রিক রাজনীতি। জাতীয়তাবাদ, তার সঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী জিগির – এসব মিলিয়ে তাদের যে রাজনীতি, সেটা কিছু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমার ধারণা – সেটা খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না পশ্চিমবঙ্গে।”

শুধু পাটাশিমূল নয়, ঝাড়গ্রাম আগে যে জেলার অন্তর্গত ছিল, তার বিস্তীর্ণ অঞ্চলেই বামপন্থীদের আধিপত্য ছিল। লালগড়, বিনপুরের মতো কিছু অঞ্চলে ছিল মাওবাদীদের ঘাঁটি।

সেখানেও আজ বিজেপি-র ভালো রকম জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে।

গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন হোক বা তার আগে পরের লোকসভার উপনির্বাচন বা ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন, বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে গোটা রাজ্যেই তাদের ভোট ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বামপন্থীদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগদান করা বা সেই দলকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আর নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর কথায়, “চৈতন্য দেবের ধর্মীয় আন্দোলন হোক বা বামপন্থীদের আন্দোলন, নানা কারণেই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জায়গা ছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতিটা ক্রমাগত বদলাচ্ছে।”

“কারণ, সরকারবিরোধী বা শাসক-বিরোধী যে দৃষ্টিভঙ্গি – যাদের কোনও ক্ষোভ রয়েছে, তারা যেহেতু আর কোনও জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদেরই একটা অংশ কিন্তু বিজেপি-র দিকে সরে যাচ্ছে। বামপন্থীদলগুলো বা বামফ্রন্টের ভোট যতটা কমেছে, সেই ততটাই কিন্তু বিজেপির দিকে গেছে।”

গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা গোটা রাজ্যেই বৃদ্ধি পেয়েছে – ২০১৪র সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচন হোক, বা দু’বছর আগের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন

তারও পরে, রাজ্যের তিন প্রান্তে আলাদা আলাদা সময়ে হওয়া কয়েকটি লোকসভা আসনের উপনির্বাচনেও দেখা গেছে যে বিজেপির ভোট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যদিও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটও অনেকটাই বেড়েছে।

জঙ্গল মহাল হোক, বা রাজ্যের অন্যান্য এলাকা, ধর্ম নিরপেক্ষ বলে পরিচিত বামপন্থীরাই এখন বেশি সংখ্যায় যোগ দিচ্ছেন রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা বিজেপিতে।

বামপন্থী নেতারা কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই প্রশ্নের?

জানতে চেয়েছিলাম রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও সিপিআই এম নেতা মানব মুখার্জির কাছে।

“আমার পুরনো পাড়া নারকেলডাঙায় পাশাপাশি হিন্দু আর মুসলিম পাড়া আছে। কখনও বিরোধ ছিল না দুই পাড়ার মধ্যে। কিন্তু বিজেপি বিরোধ সামনে নিয়ে আসছে। বিজেপির এগিয়ে যাওয়া মানে সামগ্রিকভাবে বাংলার অধঃ:পতন হওয়া। এর বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই,” বলছিলেন মি. মুখার্জী।

রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বিজেপি-র দ্রুত উত্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দল?

“অনেকেই হয়তো বিজেপি-র দিকে গিয়েছিলেন, কিন্তু আবার অনেকেই কিন্তু ফিরেও আসছেন। আমরা তাদের কিছু বোঝাতে হয় নি, বিশেষ কিছু বলতে হয় নি। নিজেরাই দেখছেন যে নোট বাতিল, জি এস টি চালু করার প্রভাব। রাজনীতির বাইরেও যখন কোথাও যাই, সেখানে কিন্তু সাধারণ মানুষই এই কথাগুলো বলছেন,” জানাচ্ছিলেন মিসেস রায়।

ভোটের প্রচারে নানা দল তো তাদের নীতি আর আদর্শের ভিত্তিতে নানা কথা বলে, নানা প্রতিশ্রুতি দেয়।

কিন্তু সাধারণ মানুষ কী চোখে দেখছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সেই প্রচারকে?

কেউ বলছেন ধর্ম আর জাতপাত বাদ দিয়ে উন্নয়নই হয়ে উঠুক আসল ভোটের ইস্যু, কেউ প্রশ্ন তুলছেন বিজেপির উন্নয়নের দাবী নিয়ে, কারও অভিযোগ ধর্মকে ব্যবহার করা হয় রাজনীতির স্বার্থে।

বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, যে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস রয়েছে, সেখানে এবারই হয়তো ভোটে ধর্মই হয়ে উঠবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। – যা অন্তত এই রাজ্যে আগে কখনও হয় নি।