পাক-মার্কিন সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে?

আহমেদ শরীফ : জুলাই মাসের শেষে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন হবে, নতুন করে তার একটা ধারণা দেন। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ইমরানের আগের বক্তব্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এবারের বক্তব্য আলাদা; কারণ এবারে তিনি নিজে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে রয়েছেন। ৮ই অগাস্ট পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন এফ হুভার ইমরান খানের সাথে দেখা করেন। ইমরান খান তাকে বলেন যে, দুই দেশের সম্পর্কে নিয়মিত উত্থান-পতনের কারণে আস্থার ঘাটতি হয়েছে। তবে ইমরান খান যে এই সম্পর্ককে মেরামত করতে ইচ্ছুক, তা-ও তিনি জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, তার দল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আস্থা এবং পারস্পরিক সন্মানের উপরে ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক, যাতে সম্পর্ক হয় ‘ব্যালান্সড’। কিন্তু ইমরান খান তার এই ইচ্ছাকে কতটা বাস্তসম্মত মনে করছেন, সেটাও ভেবে দেখার ব্যাপার রয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইটার বার্তায় সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকাকে ‘ডাবল গেম’ বা ‘দুমুখো’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন যে, গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ‘বোকার মতো’ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে; আর বিনিময়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ‘মিথ্যা ও প্রতারণা’। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্যে সহায়তা স্থগিত করে। বলাই বাহুল্য যে, ট্রাম্পের সেই বার্তার সময় ইমরান খান তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি।

বার্তা সংস্থা ‘রয়টার্স’ এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানে চীনের বিরাট বিনিয়োগের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র খুশি নয়। আর দুই দেশের সম্পর্কের এই অবনতি চলমান রয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র ঘোষণা দেন যে, সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার দায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্যে ৩’শ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পুরোপুরি বাতিল করেছে।

এর আগে গত ২৪শে আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও-এর সাথে ইমরানের ফোনালাপের পর সংবাদ সন্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করার অভিযোগ আনেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে যে, পম্পেও ইমরানকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। অন্যদিকে কোরেশী বলেন যে, এই ফোনালাপে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী’ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। কোরেশী মার্কিনীদের কাছে এই বক্তব্যের সঠিকভাবে উপস্থাপন করার কথা বললেও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের বক্তব্যে অটল থাকে। এই ঘটনাগুলি উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষতকে আরও গভীর করছে।

ব্রিটেনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীত্ব পাবার বহু আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী বক্তব্যের জন্যে পরিচিত। তিনি বরাবরই বলেছেন যে, আফগানিস্তানে এবং পাকিস্তানে সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধ এবং ড্রোন হামলার কারণেই পাকিস্তানে উগ্রপন্থার জন্ম হয়েছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লায়েন্ট’ বা ‘তাঁবেদার’ সরকার আসীন থাকার কারণে। তবে ইমরান তার এই অভিযোগগুলিতে যা উল্লেখ করেননি, তা হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিকা। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে; এমনকি যখন সামরিক শাসন জারি ছিলনা তখনও। আর ইমরানকে অনেকেই সেনাবাহিনীর কাছের লোক বলেই মনে করেন। কাজেই ইমরানের কথাগুলি যে সেনাবাহিনীর মতামতকে ছাপিয়ে নয়, তা মোটামুটিভাবে বোঝা যায়।

জানুয়ারি মাসে ট্রাম্পের টুইট বার্তা এবং পাকিস্তানের জন্যে সহায়তা মূলতবি করার পর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান সীমানা থেকে গোয়েন্দাদের দ্বারা সংগৃহীত তথ্য দেয়া বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের সীমানায় যুদ্ধ চালাতে বিমান দ্বারা সংগৃহীত তথ্য এবং ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্সের উপরে পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে। তবে আরও আগ থেকেই মার্কিনীদের সাথে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্সের সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। গত অক্টোবরে মার্কিন সিনেটের সামনে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন ম্যারিন কোরের জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ড বলেন যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘আইএসআই’ আফগানিস্তানে জঙ্গী গ্রুপগুলিকে সহায়তা দিচ্ছে।

অন্যদিকে পাকিস্তানও প্রস্তুত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা বৃদ্ধি করার বিষয়ে বলেন যে, আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিজেদের পক্ষে না যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে। এমতাবস্থায় অস্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো উৎস না খোঁজাটা হবে সবচাইতে বড় নির্বুদ্ধিতা। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর রিচার্ড ঘাইসি-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করলে পাকিস্তান চীনের উপরে আরও বেশি নির্ভরশীল হবে।

ঘাইসি-এর কথাকে শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে অনেক তথ্য রয়েছে। চীনের সাথে যৌথভাবে ডেভেলপ করা ‘জেএফ-১৭’ যুদ্ধবিমানের ব্যাপারটা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই বিমানটা চীনা সামরিক বাহিনী সার্ভিসে না নিলেও পাকিস্তান বিমান বাহিনী এই বিমানকে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষার ভিত্তি হিসেবে দেখছে। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপরে অবরোধ আরোপ করলে এই বিমানের ডেভেলপমেন্ট প্রায় স্থগিত হয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে এই বিমানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক্স যাতে কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের শিকার না হয়, সেব্যাপারে লক্ষ্য রেখেই পাকিস্তান এই বিমান তৈরি করেছে। এতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বাইপাস করার নীতিতে এগুচ্ছে। আর এই নীতিতে তারা এগুনোর চেষ্টা করছে প্রায় দুই দশক ধরেই।

প্রাক্তন মার্কিন সিনেটর ল্যারি প্রেসলার তার লেখা এক বইয়ে দাবি করেন যে, ২০১৬ সালে যে মার্কিন কোম্পানি ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের জন্যে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্যে লবিং করেছিল, সেই একই কোম্পানি ভারতের পক্ষে লবিং করে যাতে করে পাকিস্তানকে এই যুদ্ধবিমান সরবরাহ করা না হয়। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা এব্যাপারে এক প্রতিবেদনে মার্কিন অস্ত্র কোম্পানি, লবিং গ্রুপ এবং রাজনীতিবিদদের দ্বিমুখী নীতিকে তুলে ধরে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পাকিস্তানকে আরও বিচলিত করেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে যে আস্থার ঘাটতির কথা বলেছেন, তা সেনাবাহিনীর চিন্তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর দু’দেশের এই দূরত্ব হঠাতই কমে যাবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

লেখক : ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক