পৃথিবীর সকল দেশের পাসপোর্টের নকশা একই কেন?

খন্দকার মহিউদ্দিন : বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের পাসপোর্ট পাশাপাশি রাখলে দেখতে পাবেন মলাটের রং আর জাতীয় প্রতীকটি বাদ দিলে এগুলো দেখতে প্রায় একই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের পাসপোর্ট একই মাপের, একই পরিমাণ পাতার সন্নিবেশ আর একই ধরনের নকশায় তৈরি করা হয়। আপনি জানেন কি এর কারণগুলো কী কী? বাংলাদেশের পাসপোর্টের রং সবুজ হওয়ার পেছনে কারণ কী? আচ্ছা পাসপোর্টে কয়টা পাতা থাকে? আমরা কি আমাদের পাসপোর্ট বদলে লাল বা অন্য কোনো রঙের পাসপোর্ট বানাতে পারি না? অথবা আমার পাসপোর্ট কেমন হবে তা কি আমি নিজেই নকশা করতে পারি? আমরা তো জানি বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য পাসপোর্টের রং সবুজ। তাহলে বিশেষ পাসপোর্ট কী রঙের আর এই পাসপোর্ট পায়ই বা কারা? আপনার মাথায় এ ধরণের প্রশ্ন কখনো এসেছে কি? এসে যদি থাকে তাহলে আপনার জন্যেই আজকে আমরা পাসপোর্ট সংক্রান্ত আদ্যোপান্ত সব কিছুই ব্যাখ্যা করছি। চলুন শুরু করা যাক বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট:
বিদেশ ভ্রমণের দলিল হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের নাগরিকদের “বাংলাদেশি পাসপোর্ট” প্রদান করে থাকে। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি হলো বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া যায় দুই ভাবে। এক, জন্মসূত্রে আর দু্‌ই, অভিবাসনসূত্রে। তাই অভিবাসনসূত্রে বাংলাদেশী নাগরিকদেরও বাংলাদেশ সরকার পাসপোর্ট প্রদান করে থাকে। বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আওতায় যে কোনো সাধারণ নাগরিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস বা বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট দেয়া হয়ে থাকে। আর এই সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত আর কাজ বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ-১৯৭৩ এবং বাংলাদেশ পাসপোর্ট বিধিমালা-১৯৭৪  এর আওতায় করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে সাধারণ পাসপোর্টের মেয়াদ কাল ৫ বছর। আর এতে পৃষ্ঠা সংখ্যা থাকে ৪৮ টি। বাংলাদেশে ৪ ধরনের পাসপোর্ট আছে।

১. আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট- সাধারণ নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য প্রদান কর হয়,

২. বিশেষ পাসপোর্ট – শুধু ভারত ভ্রমণের জন্য প্রদান করা হত, কিন্তু এটি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে,

৩. কূটনৈতিক পাসপোর্ট – দেশের বাইরে কূটনৈতিক কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য এই বিশেষ পাসপোর্ট প্রদান করা হয়,

৪. সরকারি পাসপোর্ট – সরকারি বিশেষ প্রয়োজনে প্রদান করা হয়।

বিদ্যমান তিনটি পাসপোর্টের রং হলো:

১. সাধারণ পাসপোর্ট – সবুজ মলাট,

২. কূটনৈতিক পাসপোর্ট – লাল মলাট,

৩. সরকারি পাসপোর্ট – নীল মলাট।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট
বাংলাদেশের পাসপোর্ট এখন বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে তাল  মিলিয়ে মেশিন রিডেবল করা হয়েছে। মেশিন রিডেবল হলো এমন একটি বিশেষ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে পাসপোর্টধারীর সকল তথ্য জলছাপের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা হয় এবং বিশেষ ধরণের মেশিন দ্বারা সেটা পড়া যায়। আপনার পাসপোর্টটি যদি এখনো মেশিন রিডেবল না হয়ে থাকে তাহলে অতি শীঘ্রই পরিবর্তন করে নিন। এই ব্যাপারে যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য আপনি পাবেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। অচিরেই বাংলাদেশের পাসপোর্টের মেয়াদ ১০ বছর করবার পরিকপ্লনাও করা হয়েছে।

এসব তো গেলো বাংলাদেশের পাসপোর্টের ইতিবৃত্ত। এবার এইসব তথ্য নিয়ে চলুন মিলিয়ে দেখি পৃথিবীর আর সব দেশের পাসপোর্ট আসলে কেমন?

পাসপোর্টের রং: ভিন্ন ভিন্ন দেশের পাসপোর্টের রং ভিন্ন ভিন্ন হলেও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে পৃথিবীর সব দেশের পাসপোর্ট আসলে ৪টি মূল রং থেকে নেওয়া। এই ৪টি মূল রং হচ্ছে- লাল, নীল, সবুজ ও কালো। এই ৪টি রংকে মূল ধরে বিভিন্ন দেশ তাদের পাসপোর্টের রং নির্ধারণ করে থাকে।

কিন্তু যেই রং দিয়েই একটি দেশ তাদের পাসপোর্ট বানাক না কেন “ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েসন অর্গানাইজেসন (আইসিএও)” কর্তৃক নিজেদের রং আর নকশার ছাড়পত্র নিতে হবে। পাশাপাশি রংটি যাতে অন্য কোনো দেশের পাসপোর্টের সাথে পুরোপুরি মিলে না যায় সেই দিকটিও লক্ষ রাখতে হবে। এবারে আসা যাক এই সকল রং কেন ব্যবহৃত হয় সেই বিষয়ে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন বিশ্বের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান যার নাম “পাসপোর্ট ইনডেক্স”। তাদের মতে:

লাল: পৃথিবীর একটা বড় অংশ তথা যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট লাল রং থেকে তৈরি, অর্থাৎ মেরুন রঙের। এটা একদিক থেকে তাদের ঐক্যতা আর শক্তির একটা ব্রান্ডিং করছে। একে অনেকে “ব্রান্ডিং এক্সারসাইজ” বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। কোনো দেশ যদি যুক্তরাজ্যের সদস্য হতে চায় তাহলে তার পাসপোর্টের রং পরিবর্তন করে এই রঙের করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তুরস্কের নাম। কিন্তু যুক্তরাজ্যের বাইরের কিছু দেশও কাছাকাছি রং তাদের পাসপোর্টের মলাটে ব্যবহার করেন। যেমন – বলিভিয়া, পেরু ইত্যাদি।

সবুজ: অধিকাংশ মুসলিম দেশ তাদের পাসপোর্টের রঙে সবুজ ব্যবহার করে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তারা মহানবী (সঃ) এর প্রিয় রং সবুজ বলে উল্লেখ করে থাকেন। অনেকের ধারণা বাংলাদেশের পাসপোর্টের সবুজ রঙের পেছনেও এই কারণটি কাজ করেছে। আবার অনেকে বলে থাকেন যে পতাকার রং এই ক্ষেত্রে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে পৃথিবীর বেশিরভাগ মুসলিম দেশের পতাকাও সবুজ রঙের।

নীল: ক্যারিবিয় দেশগুলো সাধারণত নীল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকে। আর মারকোসার নামক জোট গঠনের কারণে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়ে একই ধরনের নীল পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকে। তবে এই সকল ব্যাখ্যার বাইরেও একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তা হলো উন্নত বিশ্ব আসলে এই রংটিকে পৃথিবীর রং বিবেচনায় এই ধরনের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকে এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবিতে যখন পাসপোর্ট হবে শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্য আর ব্যক্তির জন্ম আর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যের একটি বই তখন সব দেশ এই নীল রঙের পাসপোর্ট ব্যবহার করা শুরু করবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এমন কি বাংলাদেশের পাসপোর্টের রং পরিবর্তন করে নীল রং করার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।

পাসপোর্টের রং
কালো: কালো অনেক ক্ষেত্রেই কিছু দেশের জাতীয় রং নির্দেশ করে থাকে। তবে পাসপোর্টের রং নিয়ে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আসলে পাওয়া যায় কালো রং ব্যবহারকারী দেশগুলো থেকেই। তা হলো, গাঢ় রং ময়লা কম হয়। পাশাপাশি এই ৪টি গাঢ় রং থেকে আসলে অনেক শেডের রং তৈরি করা যায়।

এই সকল ধর্মীয় আর জাতীয়তার ব্যাখ্যাকে অনেকটা উপেক্ষা করেই একদল গবেষক আবার দিয়ে থাকেন তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা। সেটি হলো অর্থনীতিক দিক বিবেচনায় পাসপোর্টের রং নির্ধারণের ব্যাখ্যা।

রঙের পর এবার আসি মাপের ক্ষেত্রে:  
আপনি কি কখনো সাধারন মাপের চাইতে খুব ছোট বা বেশ বড় কোনো পাসপোর্ট দেখেছেন? অবশ্যই দেখেন নি। কারণ, পৃথিবীর সব দেশের পাসপোর্টের মাপ একই। আর এই মাপটিও “ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েসন অর্গানাইজেসন ( আইসিএও)” এর বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুসারে হয়ে থাকে। এর অবশ্য কিছু অত্যন্ত জোড়ালো কারণ রয়েছে। যেমন: সারা পৃথিবীর সকল পাসপোর্টের মাপগুলো এক হলেই কেবল একই রকম মেশিনের যে কোনোটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে। অন্যথায় প্রতিটি দেশের জন্য আলাদাভাবে প্রতিটি এয়ারপোর্টে বিভিন্ন মাপের যন্ত্র রাখা সম্ভব হত না। ভিন্ন ভিন্ন মাপের হলে একইসাথে অনেকগুলো পাসপোর্ট সংরক্ষণ করা এবং সেগুলো নিয়ে কাজ করা দুরূহ হয়ে যেতো। পাশাপাশি যাত্রীদের জন্য সেগুলো বহন করাও হতো একটি কঠিন কাজ।

তাই , ভিসা আর ইমিগ্রেসন প্রক্রিয়া সহজতর করা আর একইসাথে দ্রুততর করার লক্ষে পৃথিবীর সব দেশের পাসপোর্টের একই মাপ করার “ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েসন অর্গানাইজেসন (আইসিএও)” এর বেঁধে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত মেনেই পাসপোর্ট তৈরি করে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ।

পাসপোর্টের পাতা:
একটি দেশ চাইলেই তাদের পাসপোর্ট ৩০০ পাতা ছাপাতে পারে না। পাসপোর্ট ছাপাবার জন্য নির্দিষ্ট পাতার সংখ্যা ওই একই সংস্থা “ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েসন অর্গানাইজেসন (আইসিএও)” দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি দেশ তাদের পাসপোর্ট এর পাতাগুলো সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রয়োজনীয়তা অনুসারে সন্নিবেশ ও পুনঃসন্নিবেশ করতে পারে।

যেমন বাংলাদেশের পাসপোর্টের প্রথম পাতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দ্বারা আদেশক্রমে পাসপোর্টের নির্দেশাবলী বাংলা ও ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পক্ষে সংশ্লিষ্ট সকলকে এই মর্মে জানানো যাইতেছে এবং প্রত্যাশা করা হইতেছে যে, ইহার বাহককে অবাধে ও বিনা প্রতিবন্ধকতায় গমনাগমনের অনুমতি এবং তাহার প্রয়োজনে সকল প্রকার সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রদান করা হউক।” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে।

দ্বিতীয় পাতায় মুল তথ্য লিখিত থাকে। যেমন-  বাহকের ছবি, বংশগত নাম, প্রদত্ত নাম, জন্মস্থান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, স্বাক্ষর ইত্যাদি। তৃতীয় পাতায় থাকে পাসপোর্ট ধারকের জন্য একটি নির্দেশাবলী। এভাবে সন্নিবেশিত হয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ৪৮ পাতার পূর্ণাঙ্গ একটি পাসপোর্টে পরিণত হয়।

ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর সকল দেশের পাসপোর্টের নকশা “ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েসন অর্গানাইজেসন (আইসিএও)” দ্বারা নির্দিষ্ট করা থাকলেও প্রতিটি দেশ তাদের নিজেদের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে তাদের পাসপোর্টের বিভিন্ন পাতা সন্নিবেশ করতে পারে। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা দরকার। পাসপোর্ট ছাপানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। পৃথিবীতে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি কোম্পানি কাজটি করে থাকেন। বাংলাদেশের পাসপোর্টও সেরকম একটি কোম্পানি থেকে ছাপিয়ে আনা হয়। আপনি যে পাসপোর্টটি হাতে পান সেটি আসলে পূর্বে ছাপানো একটি পাসপোর্টের উপর পুনর্মুদ্রিত। তাই কোনো দেশ বা ব্যক্তি চাইলেই তার ইচ্ছামতো একটি পাসপোর্ট ছাপিয়ে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করা শুরু করতে পারেন না।

গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা: মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের এই যুগে পাসপোর্ট একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গোপন তথ্যভাণ্ডার। এই সকল তথ্যকে গোপন রাখবার জন্য পাসপোর্টের নকশা থেকে শুরু করে আপনার হাতে আসা পর্যন্ত অসংখ্য গোপন সংখ্যা আর তথ্য আপনার পাসপোর্টের বিভিন্ন জায়গায় সন্নিবেশিত করা হয়। প্রতিটি দেশের পাসপোর্ট অভিন্ন নকশায় তৈরি করার কারণ হলো এই সকল তথ্য গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার সর্বোচ্চ সহজলভ্যতা ও সর্তকতা নিশ্চিতকরণ।

এই ছিল বর্তমান বিশ্বের পাসপোর্টের নকশার কারণসমূহ। পৃথিবীতে আসলে এমন একটি দিন খুব শীঘ্রই আসবে যেদিন পাসপোর্টের কোনো প্রয়োজন হবে না। থাকবে না এরকম নকশার কোনো পাসপোর্টের বই। খুব শীঘ্রই আশা করা যায় একটি কার্ডের মধ্যে এধরনের সকল তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়ে যাবে। যেটা হবে আরও নিরাপদ এবং যেটাকে জাল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ভবিষ্যৎ পাসপোর্টের রূপ রহস্য নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করব। সেই সুদিনের প্রত্যাশায় আনন্দময় ও নিরাপদ হোক আপনার ভ্রমণ।-প্রিয়.কম