প্রতিনিয়ত হামলা-সহিংসতা : আতঙ্কে ভোটাররা

‘নির্বাচনের পরিবেশ এখনো নেই’, ‘শংকায় আছি, ভোট দিতে পারবো কিনা’, ‘আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি’, ‘প্রার্থীই যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’

বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই সহিংসতা নির্বাচনী পরিবেশের ওপর কি প্রভাব ফেলছে, ভোটাররা কতটা উদ্বেগ বোধ করছেন – এসব প্রশ্ন নিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে শোনা গেল এরকমই কিছু উত্তর।

৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু হতে না হতেই – রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রার্থীদের মিছিলে আক্রমণ, গাড়িবহরে হামলা, ভাংচুর-সংঘর্ষ ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে। সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের বেশ কয়েক জন সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাও এসব হামলায় আক্রান্ত হয়েছেন।

উৎসবমুখর একটা নির্বাচনের যে আশা ভোটারদের ছিল – এসব হামলার খবরে কি ভোটাররা উদ্বিগ্ন ? কতটা নিরাপদ বোধ করছেন তারা এই পরিস্থিতিতে?

জানতে কথা বলেছিলাম বেশ কয়েকজনের সাথে।

ঢাকার একটি আসনের ভোটার শান্তা আখতার। পেশায় চাকরিজীবী। আর কয়েকদিন পরেই নির্বাচন, তাই ভোটার হিসেবে নিজের ভোটটা দেয়ার উৎসাহ ছিল তার মধ্যে।

কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই যেভাবে প্রার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে তার খবর দেখে তিনি বলছেন, তিনি আতঙ্কিত বোধ করছেন।

“এখন যে অবস্থা সেটাতে করে যেকোন সময় একটা নাশকতামূলক অবস্থা তৈরি হতে পারে। তাই ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি” – বলছেন এই নারী ভোটার।

শান্তা আখতার বলছিলেন – “রাজনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল না সেটা আমরা জানি এবং দেখতে পাচ্ছি। এই ক্ষেত্রে আমরা ভোট দিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে পুরুষ অভিভাবক রয়েছে তারা সবসময় চায় যেন আমরা একটা নিরাপদ জায়গায় থাকি।

আরো ঢাকার আরেকজন নারী ভোটারও বলছিলেন – পরিবার থেকেই তাদের এখন একটা সতর্কতার মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে।

তিনি বলছিলেন “অন্তত আমরা নিরাপত্তার সাথে বাইরে, রাস্তায় বের হতে পারতাম। কিন্তু এখন আমাদের শোনার মত কেউ নেই। মেয়েরা যে রাস্তায় বের হলে বিপদে পড়তে পারে সেটা চিন্তা করার মত কেউ নেই। এক্ষেত্রে পরিবার থেকেই একটা বাধার মুখে পড়ছি”।

প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রার্থী – সবাই এরকম হামলার শিকার হয়েছেন।

কথা হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুষ্টিয়ার কয়েকজন ভোটারের সাথেও । নাম প্রকাশ না করা একজন ভোটার বলছিলেন, নির্বাচনের দিন ভোট দিতে যেতে পারবেন কীনা সেটা নিয়ে তার মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

“ভোট তো দেয়ার মত কোন পরিবেশ নেই। আর যদিও পরিবেশ থাকে – সেক্ষেত্রে সিল সামনে মারতে হবে। আর যদি তারা (রাজনৈতিক দলের নেতারা) মনে করে এই লোকটা আমার ভোট দেবে না তাহলে সে টার্গেটে থাকে। তার গতিবিধি, চলাফেরা সব টার্গেট করা হয়। আমরা সাধারণ ভোটার যারা তারা তো আতঙ্কের মধ্যে আছি” – বলেন এই ভোটার।

প্রচারণা শুরুর পর থেকে জাতীয় ঐক্য-ফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নরসিংদীতে মঈন খান, ঢাকায় মির্জা আব্বাস, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম আজাদসহ বেশ কয়েকজন নেতার প্রচার মিছিল বা গাড়িবহরে হামলার খবর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।

অন্যদিকে হাসানুল হক ইনুর সভাসহ মহাজোট বা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড আক্রান্ত হবার অভিযোগ পাওয়া গেছে নড়াইল, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও সদর উপজেলা সহ নানা এলাকা থেকে।

সিরাজগঞ্জের একজন ভোটার বলছিলেন – যদি প্রার্থীদের ওপর হামলা হয় তাহলে সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোথায়?

তিনি বলছিলেন “বর্তমান যে পরিবেশ আছে সেই পরিবেশ থাকলে তো আমরা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারবো না। এখনো পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি ভোট দেয়ার মত। আমরা একটা আতঙ্কের মধ্যে আছি।

“যারা রাজনৈতিক কর্মী, নেতা – তারাই মার খাচ্ছে, আর আমরা সাধারণ মানুষতো কেন্দ্রেই যেতে পারবো না” – বলেন নাম-প্রকাশ-না-করা এই ভোটার।

নির্বাচনের পূর্বে এই ধরণের হামলা এবং সহিংসতার ঘটনা ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দেখা যায়নি বলে বিবিসি বাংলার কাছে মন্তব্য করেছিলেন একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার।

তবে এবারের নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ফলে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবার কথা – সেটা অনেকটাই উবে গেছে ভোটারদের মন থেকে।

তাদেরকে আস্থায় আনার জন্য বা এই সব হামলা সহিংসতা ঠেকাতে নির্বাচনের কমিশনের কিছু করার আছে কীনা?

এই বিষয়ে জানতে আমি একাধিক কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোন মন্তব্য পাওয়া যায় নি। কয়েকদিন আগে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, সহিংসতার ঘটনার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন, এবং প্রক্রিয়া অনুযায়ী অভিযোগগুলো তদন্ত করেই কমিশন ব্যবস্থা নেবে।-বিবিসি বাংলা