প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বাংলাদেশ বিমান আছড়ে পড়ার মুহূর্ত

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে দুর্ঘটনায় পড়া বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটির গুরুতর আহত যাত্রীদের দেশটির সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

বিমানটিতে ৩৩ জন যাত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে ১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে বুধবার চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয় । এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল নাগাদ চার জনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশের মুখপাত্র শাকিল মিরাজ।

দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বৃহস্পতিবার।

প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীর বর্ণনায় দুর্ঘটনার মুহূর্ত

বিমানের ওই ফ্লাইটটিতে থাকা আহত যাত্রীদের একজন ঢাকার রেজওয়ানা খান, যিনি একজন প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা তিনি ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা। শুক্রবার মিয়ানমারে একটি ব্যবসায়িক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার।

কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার কারণে এই মুহূর্তে তিনি ইয়াঙ্গুনের বেসরকারি এআরওয়াইইউ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সেখান থেকে বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে তিনি বলেছেন, বিমানটি যখন রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে সেই সময়কার মুহূর্ত কেমন ছিল।

তিনিসহ অন্য যাত্রীরা প্রথম দিকে বিপদের আশংকা আঁচ করতেও পারেননি।

“আমরা তো নরমাল ছিলাম। কারণ এরকম থান্ডার-স্টর্ম [বজ্রপাত] তো অনেক সময়ই হয়।”

“একটা সময় বিমানটি জোরে একটি ঝাঁকুনি খায় এবং তারপর আছড়ে পড়ে। তার আগে আমরা বুঝতেই পারিনি কী ঘটতে যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিয়ানমারের এআরওয়াইইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেজওয়ানা খান।

“প্রথমে থান্ডার-স্টর্ম হচ্ছিল, পাইলট আধা-ঘণ্টার বেশি আকাশে চক্কর দিচ্ছিলেন। নামার চেষ্টা করেও নামতে পারছিলেন না, তখন অন্য দিকে ঘুরে যান।”

একটা সময় পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন বলেও জানান মিজ খান।

“পাইলট একটা সময় ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন; যে কারণে বিমানে আগুন লাগেনি বলে আমরা মনে করছি।”

তাদেরকে বারবার বলা হচ্ছিল এক্সিট ডোর খোলার চেষ্টা করতে।

“আমি বিমানের পেছনের দিকে ছিলাম। আমাদের বলা হচ্ছিল আপনারা এক্সিট ডোর পুল করেন, শুরুতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টার পর ডানদিকেরটা পুল করতে পারলাম।”

তিনি জানান, বিমানটি আছড়ে পড়ে জোরে একটা ঝাঁকুনি লাগায় তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন।

এরপর তাদের দ্রুত বের করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাসপাতালে তার মুখে সেলাই লেগেছে বলে জানান তিনি।

“চোখে চশমা থাকায় আমার নাক কেটে গেছে, ব্লিডিং হিচ্ছল, স্টিচ লেগেছে।”

তবে তিনি মনে করেন, পাইলটের দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তায় তারা বেঁচে গেছেন।

তিনি বিমানের ফ্লাইটে মানুষের জীবনের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও কথা বলেন।

“প্লেনটা আসলে দেখা উচিত। এভাবে স্কিট করলো, বাম্প করলো, এত পুরনো ফ্লাইট,…এগুলো দেখা দরকার।”

আহতদের তিন-দফা হাসপাতাল বদল

এদিকে মিয়ানমারে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মুনিমউল ইসলাম বিবিসিকে জানান, আহত যাত্রীদের তিন দফা হাসপাতাল বদলাতে হয়েছে।

দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই মুনিমউল ইসলাম সহ মিয়ানমারে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা অনেকেই ছুটে যান বিমানবন্দরে। এরপর রাতে হাসপাতালেও আহতদের খোঁজখবর নেন তারা।

মুনিমউল ইসলাম আজ দুপুরেও গিয়েছিলেন এআরওয়াইইউ হাসপাতালে।

সেখান থেকে তিনি জানান, শুরুতে আহতদের বিমানবন্দর থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে নর্থ ওকলাপা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে তাদের ইয়াঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

“সর্বশেষ সেখান থেকে একজনকে ছাড়া বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে এআরওয়াইইউ হাসপাতালে। ড. ফরিদ নামে একজন বাংলাদেশী চিকিৎসককে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে তিনিই কেবল ইয়াঙ্গুন হাসপাতালে রয়েছেন।”

কী বলছে বিমান বাংলাদেশ?

বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। দুর্ঘটনার পেছনে কারণ কী ছিল সে বিষয়ে তারা রিপোর্ট দেবে।

বৃহস্পতিবার বিমানের মুখপাত্র শাকিল মিরাজ বলেন, তদন্ত কমিটি প্রাথমিক ও চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করবে।

তবে বুধবার ইয়াঙ্গুন সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া মিডিয়া রিলিজ অনুসারে সেখানে অবতরণের সময় প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাত হচ্ছিল, রানওয়ে ভেজা এবং পিচ্ছিল ছিল, বৈরী আবহাওয়া ছিল।

এছাড়া মিয়ানমারের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানান শাকিল মিরাজ।

পাইলটের রক্তাক্ত অবস্থার ছবি সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে। সে বিষয়ে মিস্টার মিরাজ বলেন, পাইলটসহ প্রত্যেক যাত্রী এখন শঙ্কামুক্ত আছেন বলে মিয়ানমারের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।

“আমাদের অপারেটিং ক্যাপ্টেন যিনি ছিলেন প্লেন থেকে তিনি হেঁটে চলে এসেছেন, কোনো স্ট্রেচারে বা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেননি। কিন্তু তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, কিছু ব্লিডিং হয়েছে, তাকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”

আহত যাত্রীদের মধ্যে যাদের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেবে শনিবার তাদের ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিমানের কাঠামোগত বিশাল ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিমানের ইঞ্জিনিয়ার-দল সেখানে পৌঁছেছে, তারা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবেন।

বিমানের ফ্লাইট ০৬০ বুধবার দুপুর ৩টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে।

সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটে ইয়াঙ্গুনে অবতরণের সময় বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে।

বিমানটিতে মোট ৩৩ জন আরোহী ছিল। তাদের মধ্যে চারজন বিমান ক্রু এবং বাকি ২৯ জন যাত্রী।