প্রশ্নফাঁসের মহামারি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থাকে?

কোথায় নেই প্রশ্নফাঁস? পাবলিক পরীক্ষা থেকে শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষা; নিয়োগ পরীক্ষা থেকে ভর্তি পরীক্ষা সব ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের এক মহামারি চলছে দেশে।

সর্বশেষ সোমবার ফাঁস হয়েছে নাটোর সদর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র। শুধু তাই-ই নয়, ফাঁস হয় এই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও।

নাটোরের ওই বিদ্যালয়টির নাম আগদিঘা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সকালে প্রথম ও চতুর্থ শ্রেণির গণিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার পরে অভিভাবকদের হাতে হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের ফটোকপি দেখা যায়। আগেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মিল দেখে স্থানীয় অভিবাবকরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

একপর্যায়ে বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালে তারা দু’জনেই ঘটনাস্থলে গিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মূল প্রশ্নপত্রের মিল দেখতে পান। এক পর্যায়ে তারা পরীক্ষাগ্রহণ বাতিল ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে আগদিঘা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিপ্রা রানী দত্ত বলেন, ‘নাটোর সদর উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্র একই। সুতরাং কিভাবে কোথা থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তা আমার পক্ষে বলা কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি আমার হেফাজত থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।’

বিগত কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার আগেই সামাজিক মাধ্যম সয়লাব হতে দেখা গেছে পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। অভিভাবকদের হাতে হাতে দেখা মিলছে সেসব প্রশ্নপত্র। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দৃঢ়তার সাথে তা অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ।শিক্ষামন্ত্রী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও কার্যকর কোনো ফল দৃশ্যমান হচ্ছে না।

শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের’ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ‘অসাধু’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রও যুক্ত থাকতে পারে বলে দুদকের তদন্তকারীদের ধারণা।

প্রশ্নফাঁস, নোট-গাইড, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে ৩৯ দফা সুপারিশসহ ওই প্রতিবেদন গত ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, শিক্ষা সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়।

প্রশ্নফাঁসের এ মহামারির জন্য পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে বিশিষ্ট শিক্ষা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ভয়াবহভাবে পরীক্ষা কেন্দ্রীক করে ফেলা হয়েছে।

‘ক্লাসরুমে সে কী শিখছে, শিক্ষকরা কেমন পড়াচ্ছেন তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখলো বা জানলো তা না দেখে দেখা হচ্ছে পরীক্ষায় কে কত ভালো করছে। শিক্ষার্থীরা মূলবই না পড়ে গাইড নোটের পেছনে ছুঁটছে। যে কোনো উপায়ে ভালো ফল করার মানসেই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধংস করে দিচ্ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইমেরিটাস অধ্যাপক মনে করেন, প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে হলে এই পরীক্ষা কেন্দ্রীকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এসএসসির আগে কোনো পরীক্ষা থাকা উচিত নয়। আর শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র স্কুলেই প্রণয়ন করতে হবে।

তাছাড়া শিক্ষাকে ‘পণ্যায়ন’ করে ফেলার দায়ও দেখছেন তিনি।

‘‘অভিভাবকদের মনে এক ধরনের ধারণা প্রোথিত করা হয়েছে যে শিক্ষাও এক ধরনের পণ্য এবং তা কিনতে পাওয়া যায়। তাই তারা টাকা ব্যয় করে ছোটে প্রশ্নপত্রের পেছনে।’’

যেকোন ‍উপায়ে হোক প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে বলে মনে মত দেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।