প্রশ্ন ফাঁস : প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের দাবি সর্বত্র

পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে দেশজুড়ে। এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের গুঞ্জন এখন পাবলিক পরীক্ষার সকল স্তরে। একইভাবে পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের ভুল-ভ্রান্তি। ফলে এ পরীক্ষা নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছেন অভিভাবকরা। এর মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক মানসিক চাপ ছাড়া আর কোনো অর্জন হচ্ছে না। তাই পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা বাতিলের দাবি অভিভাবক-শিক্ষাবিদদের।

সর্বস্তরে পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিলের দাবির বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরীক্ষা বাতিলের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের একার নয়। সরকার যতদিন চাইবে ততদিন এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

তবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ মানতে রাজি নয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এমন অভিযোগকে শুধুমাত্র গুজব বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। এমন কাজের সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম এফ এম মনজুর কাদির। তিনি বলেন, নানা জায়গা থেকে পিইসি-সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ আসলেও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোথাও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর প্রমাণ না পেলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়।

কয়েকটি কেন্দ্রে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একাধিক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। কারও বিরুদ্ধে কোন অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত ১৯ নভেম্বর ইংরেজি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির পিইসি-সমাপনী পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। পরীক্ষার আগের রাতেই আজকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফেসবুক, টুইটার, ভাইবারসহ যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, গতকাল সারাদেশে পিইসির সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার ৭ নম্বর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী মো. জুয়েল ও ফটোকপি দোকানদারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। নৈশ প্রহরী প্রশ্নপত্রটি দোকানে ফটোকপি করতে যায়, পাশের লোকজন তা বুঝতে পারলে হইচই পড়ে। পরে পুলিশ এসে ওই দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ৫০ নম্বরের মিল রয়েছে। পরে এ বিষয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া কুমিল্লা বোর্ডের ইংলিশ ভার্সনের প্রশ্নপত্রে অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়েছে। যদিও বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুরের সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল মান্নানকে প্রশপত্র ভুলের দায়ে সাময়িকভাবে বরখান্ত করা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই নামের কোন কর্মকর্তা সাদুল্ল্যাপুরে নেই। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, যাদের দ্বারা অনিয়ম হবে আমরা তাদের ছাড় দিব না। ভুল প্রশ্ন তৈরি করায় আজ এই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না।

তথ্যমতে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নগুলো তৈরি হয় ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিতে। সেখানে নির্ধারিত প্যানেলের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রগুলো প্রণয়ন করা হয়। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্রে ব্যাপক ভুল ছিল। সেখানে বাক্য গঠন থেকে শুরু করে নানা ধরনের ভুল পাওয়া গেছে। সিলেট ও নারায়ণগঞ্জে এই প্রশ্ন দিয়েই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রশ্ন অনুবাদের দায়িত্বে ছিলেন বরখাস্ত হওয়া ওই কর্মকর্তা।

এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর একাধিক পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষারত অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা অভিযোগ করেন, আমরা সারা বছর সন্তানকে স্কুলে, কোচিংয়ে ও বাসায় শিক্ষক দিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছি। অথচ অনেকে রেডিমেট প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসই যদি হয়, তবে আমরা কেন এত কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে পড়ালেখা করাব? প্রশ্ন ফাঁস রোধ ও পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান অভিভাবকরা।

নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সামনে কয়েকজন অভিভাবক বলেন, পঞ্চম শ্রেণির এ পরীক্ষার ফল ছাত্রছাত্রীর জীবনে কোথাও কাজে আসে না। শুধুমাত্র অভিভাবক ও ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়তি টেনশন তৈরি হয়। তার মধ্যে যদি পঞ্চম শ্রেণির প্রশ্ন ফাঁস হয় তবে এ পরীক্ষা নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এতে করে শিশুদের শারীরিক-মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

কেউ সারা বছর পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, আবার কেউ না পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল পাচ্ছে। এতে করে আমাদের সন্তানরা পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। তারা অতিসত্বর প্রশ্নফাঁস বন্ধ ও পিইসি-সমাপনী পরীক্ষা বতিলের দাবি জানান।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পাস করলে তাদের দ্বারা কিছুই আশা করা যায় না। সরকার ঘন ঘন পরীক্ষা আয়োজন করায় মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ফাঁসের চিন্তা ঢুকে গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পাস করার পর তারা দেশের বোঝা ছাড়া আর কিছু হয় না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের নৈতিকতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের দ্বারা ভালো কিছু আশা করা যাবে না।

যে শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান বিষয়ে ধারণা নেই, সে যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে প্রকৌশলী হয় তবে লাভ কি? এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সরকারের পলিসির কারণে আজ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই সরকারকে কঠোর হাতে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে হবে। এর সহায়ক হিসেবে তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা বাতিলের পরামর্শ দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, এবার সমাপনী-ইবতেদায়ি পরীক্ষায় ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৭৬ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে। তার মধ্যে সমাপনীতে ২৮ লাখ ৪ হাজার ৫০৯ জন, আর ইবতেদায়িতে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৬৬ পরীক্ষার্থী রয়েছে।