ফিনল্যান্ড এত সুখী কেন?

১৮৬০ সালে ফিনল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়; এতে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ মানুষ মারা যায়। সেই থেকে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। গত মার্চের শুরুর দিকে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল সল্যুউশন নেটওয়ার্ক বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ডের নাম ঘোষণা করেছে। নর্ডিক অঞ্চলের প্রতিবেশি তিন দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং আইসল্যান্ড যথাক্রমে ফিনল্যান্ডের পরে অবস্থান করছে।

অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের সূচকের প্রথমে অবস্থান করায় ফিনল্যান্ডের নাগরিকরা দম্ভ করতেই পারেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের দেশটি সবচেয়ে স্থিতিশীল, সবচেয়ে মুক্ত এবং সবচেয়ে নিরাপদ দেশের তকমা পেয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে।

এসব সহজেই বোধগম্য। ফিনল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে তাপমাত্রা নিয়মিতভাবে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকে এবং বছরের বড় একটি অংশ জুড়ে দেশটির কিছু অংশে সূর্যের আলো কদাচিৎ দেখা যায়। সেই দেশটিতে স্থানীয়দের সুখী হওয়ার মতো এত কি আছে?

ফিনল্যান্ডের মানুষ তাদের জীবন নিয়ে কি ধরনের সুখ অনুভব করেন; এমন প্রশ্নে ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালাপের জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মাথাপিছু জিডিপি, সামাজিক সহায়তা, সুস্থ্য-জীবন প্রত্যাশা, জীবনযাপনের অবাধ স্বাধীনতা, উদারতা এবং দুর্নীতি থেকে স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন ধরনের ভেরিয়েবল ব্যবহার করে গবেষকরা পার্থক্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর সঙ্গে ফিনল্যান্ডের পার্থক্য খুবই সামান্য এবং শীর্ষে যে পাঁচটি দেশ রয়েছে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি কয়েকবছর ধরে। এ বছরের প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো অভিবাসীদের সুখও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এই ক্যাটেগরিতেও শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড।

আর এতে এটা পরিষ্কার, সহায়ক সামাজিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানই সুখী সমাজ তৈরি করে; যেখানে মানুষের বিপদে পড়ার কোনো শঙ্কা থাকে না। তারা আরো বেশি অভিবাসী গ্রহণ ও তাদের ভরণ-পোষণে আগ্রহী।

তবে সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত ও সহিংসতাকবলিত দেশগুলো একেবারে নিচে রয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় উদযাপন করার মতো অনুসঙ্গও কিছুই অবশিষ্ট নেই।

ফিনল্যান্ডের সুখের গোপন রহস্য অনেকের মনঃপুত নাও মনে হতে পারে। ফিনিশ এক নাগরিক যা বললেন তার সার-সংক্ষেপ হলো : ‘আপনার নিজস্ব লাল কুঁড়েঘর ও গোল আলুর একখণ্ড জমি আছে; এটাই সুখ।’

বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাভাবিক পিতৃত্বকালীন ছুটি ও কাজের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করেছে যে, মানুষের আনন্দ উপভোগ করার সময় আছে। দেশটির পুলিশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-সেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থা আছে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের। উন্নত কর ব্যবস্থা ও সম্পদের পুনর্বন্টন, ধনী এবং গরীবদের জীবনাচরণে নাটকীয় কোনো পার্থক্য না থাকায় এটি সম্ভব হয়েছে। এমনকি নারী-পুরুষেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একজন মা, একজন কর্মজীবী নারীর জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোর একটি হচ্ছে ফিনল্যান্ড।

যদিও দেশটিতে আত্মহত্যার হার অত্যন্ত বেশি। তারপরও ২০০০ সালের মধ্যে এ হার ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়। শক্তিশালী সমর্থন নেটওয়ার্ক ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নীতিমালার কারণে দেশটিতে অভিবাসীরাও সুখে আছেন। এছাড়া ফিনল্যান্ডে বসবাসরত অভিবাসীরা প্রতিবেশি এস্তোনিয়া এবং রাশিয়ার মতো জায়গা থেকে আসেন; যা সাংস্কৃতিকভাবে প্রায় একই ঘরানার।

ফিনল্যান্ডের র্যাঙ্কিংয়ে বিস্ময়কর কিছু বিষয় রয়েছে। এর একটি হচ্ছে, সবচেয়ে সুখী দেশগুলোকে শীর্ষ ধনী হওয়ার দরকার নেই। গত ৪০ বছর ধরে আমেরিকার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে; তবে এতে জনগণের মঙ্গলের জন্য তেমন কিছুই বৃদ্ধি পায়নি। ২০১৬ সালে সুখী দেশের তালিকায় ১৩ তম অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র; চলতি বছরে তা ১৮ তম অবস্থানে নেমে এসেছে। ব্রিটেন আছে ১৯ তম স্থানে। ধনী দেশগুলোর পতনের পেছনে স্থূলতা, হতাশা ও মাদক আসক্তি অন্যতম কারণ বলে গবেষকরা মন্তব্য করেছেন।

এছাড়া বিভিন্ন বয়সী মানুষ, সংস্কৃতি ও সমাজ আনন্দকে আলাদা আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করে। ল্যাটিন আমেরিকার নাগরিকরা বলছেন, তারা দেশের সম্পদ, দুর্নীতি বা উচ্চ মাত্রার সহিংসতার মধ্যেও সুখী আছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধনের মধ্যেই সুখ নিহিত। এক্ষেত্রে তাদের সামাজিক বিভিন্ন উপাদান ও জাতীয় সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিনল্যান্ডে একটি শব্দ রয়েছে, ‘সিসু’। যার অর্থ হচ্ছে, আপনার চলার পথে যাই আসুক না কেন দৃঢ় উদ্যম ও মনের জোর ধরে রাখুন।

# ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ