ফুটপাতের দোকান: প্রতিদিন লাখ টাকার চাঁদা যাচ্ছে কাদের পকেটে?

রাজধানীর উত্তরা পূর্ব ও পশ্চিম থানা এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত দখল করে নিয়মিত প্রায় দেড় হাজার অবৈধ দোকান বসে। এতে সৃষ্টি হয় যানজটের। চলাচলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় পথচারী ও সাধারণ মানুষকে।

উত্তরার বাসিন্দারা বলছেন, পুলিশ নিয়মিত তদারক না করার কারণেই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা ফুটপাত-রাস্তা দখল করার সাহস পাচ্ছেন। অভিযোগ আছে, পুলিশের অনেক সদস্যই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা পান। তাই তাঁরা এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেন না।

ফুটপাতে বসা ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবসা করতে দৈনিক তাঁদের ১০০-১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন এই চাঁদা তোলার দায়িত্বে আছেন বেশ কয়েকজন লাইনম্যান। তাঁদের মধ্যে প্রভাবশালী হলেন রুবেল হোসেন ওরফে মোটা রুবেল, মো. দুলাল ওরফে লম্বা দুলাল, মো. আতিক মিয়া ও প্রিন্স মামুন। এই চারজনকে ব্যবসায়ীরা পুলিশের লাইনম্যান হিসেবেই চেনেন। কারণ, নতুন কেউ পজেশন (দোকান বসাতে) নিতে চাইলে এই চারজন লাইনম্যানই ঠিক করেন, নতুন ব্যবসায়ীরা কোথায় দোকান নিয়ে বসবেন। তাঁরা স্থানীয়ভাবে কৃষক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

তবে উত্তরা পশ্চিম থানা কৃষক লীগের সভাপতি আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, এঁদের কাউকে তিনি চেনেন না। এই নামের কেউ কৃষক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

নতুন দোকান বসানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে লাইনম্যান মামুন বলেন, চাইলেই ফুটপাতে দোকান বসানো যাবে। তবে টাকাটা নিয়মিত দিতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিকেল থেকে চাঁদা তোলা শুরু হয়। মাঝেমধ্যে রাতেও তোলা হয়। আর চাঁদা আদায় শেষে লাইনম্যানরা রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের পেছনে জড়ো হয়ে আদায় করা টাকার হিসাব করেন। প্রতিদিন দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা ওঠে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁদা দিতে না চাইলে ব্যবসা বন্ধ করে দোকানের মালামাল রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। টহল পুলিশ এসে থানায় কিংবা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে যায়। এই ভয়েই তাঁরা সবাই চাঁদা দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমে জসীমউদ্‌দীন থেকে উত্তরা বিএনএস টাওয়ার পর্যন্ত সার্ভিস সড়ক ও ফুটপাতে প্রায় সাড়ে তিন শ, হাউস বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ড থেকে ১২ নম্বর সেক্টর ময়লার মোড় পর্যন্ত সোনারগাঁও জনপথ সড়কে আড়াই শ, রবীন্দ্রসরণিতে সড়ক বিভাজকে ৭০টির মতো, মূল সড়ক ও ফুটপাতে দেড় শতাধিক, গাউসুল আজম, শাহ মকদুম ও গরীবে নেওয়াজ—এই তিন সড়কের ফুটপাত ও রাস্তায় শতাধিক দোকান নিয়মিত বসে। এগুলো বেশির ভাগই কাপড়ের দোকান। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে সবজি, ফল এবং বিভিন্ন খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকান বসে কয়েক শ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়মিত বসে এমন দোকানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। বেশির ভাগ দোকান ভ্যানগাড়ির। এ ছাড়া কাঠের চৌকি এবং বাঁশ-টিনের তৈরি টং দোকানও অনেক।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জসীমউদ্‌দীন মোড় থেকে বিএনএস টাওয়ার পর্যন্ত সড়কের পশ্চিম পাশে টাকা তোলে মো. রুবেল মিয়া, হাউস বিল্ডিং থেকে পশ্চিমে উত্তরা ১২ নম্বর খালপাড় ও উত্তরে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত মো. দুলাল এবং পূর্ব দিকে আবদুল্লাহপুর থেকে রাজলক্ষ্মী পর্যন্ত মো. আতিক। আরেকজন লাইনম্যান প্রিন্স মামুন আজমপুর, রাজলক্ষ্মী ও রবীন্দ্রসরণির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। মামুনকে চাঁদা তোলার কাজে মেহেদী নামের একজন ব্যবসায়ী সাহায্য করেন। মেহেদীর নিজেরও রবীন্দ্রসরণিতে কাপড়ের দোকান আছে।

রবীন্দ্রসরণিতে প্রায় ১০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন, এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাঁচ-ছয় বছর আগেও এভাবে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু এখন দিনের চাঁদা দিনেই দিতে হয়। নির্দিষ্ট চাঁদার টাকা কম হলে টাকা নেন না লাইনম্যানরা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী জাকির মোল্লা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে আজমপুর ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর গাজীর বিরুদ্ধে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। সম্প্রতি আলমগীর গাজী পদোন্নতি পেয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

উত্তরার ওই দুই থানা এলাকার ফুটপাত ও রাস্তাঘাট নিয়মিত দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব আজমপুর পুলিশ ফাঁড়ির। চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে আলমগীর গাজী বলেন, ‘আমি চাঁদাবাজি করি না, আমার কোনো লাইনম্যানও নেই। কোনো লাইনম্যানকে চিনি না।’
উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে নিয়মিত বসা দোকানের সংখ্যা বেশি। উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় এমন দোকানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী হোসেন খান বলেন, ‘ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান করছি। যাঁরা এভাবে ব্যবসা করেন, তাঁদের আইনের আওতায় এনে মামলাও দেওয়া হচ্ছে।’ চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

আর উত্তরা পূর্ব থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক বলেন, ব্যবসায়ীরা সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কারণ, পুলিশ নিয়মিতই অবৈধ দোকানের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালায়।-প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।