ফের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন হাসিনা

‘তারাও মানুষ। যতদিন তাদের (বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা) ফেরত নেয়া না হয়, ততদিন তাদের আশ্রয় দেব, যাতে তারা খাদ্য ও চিকিৎসা পায়।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন কথায় আশান্বিত হয়েছেন রহিমুল্লাহ, সাজেদা বেগম ও সাবেদের মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা। যারা নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রী, শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি’র সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে ভিটেমাটি সবকিছু হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন প্রিয় স্ত্রীকে, কেউ স্বামীকে আবার কেউ কেউ প্রিয় সন্তানদের।

সবকিছু হারিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নই যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন তারা। কিন্তু মঙ্গলবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশার বাণীতে তারা আবারও আশান্বিত হয়েছেন, নতুন করে দেখতে শুরু করেছেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

মঙ্গলবার কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ চোখে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট, তাদের ওপর বর্বর বার্মিজ সেনাদের নির্মম নির্যাতনের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা।

তিনি এ সময় ঘোষণা দেন, তারা (রোহিঙ্গারা) যতদিন এখানে থাকবে ততদিন আমরা তাদের বিনয়ের সঙ্গে থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।

‘এমন ভয়াবহ অবস্থায় আমরা তাদের ফেরত পাঠাতে পারি না। আমরাও মানুষ’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে, সেটি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। তিনি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘এ ঘটনা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। মানুষ মানুষের মতো বাঁচবে। মানুষের কেন এত কষ্ট!’

‘তারা (মিয়ানমার) আইন পরিবর্তন করে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করছে। আইন পরিবর্তন করে কেন এ ঘটনার সৃষ্টি করা হলো?’- প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গ রহিমুল্লাহ, সাজেদা বেগম ও সাবেদেরও প্রশ্ন, কেন তাদের নির্যাতন করে নিজ জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হলো? কেন তাদের পরিবারের স্বজনদের নির্মমভাবে গুলি করে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো? আমাদের কী দোষ?

টেকনাফের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন রহিমুল্লাহ (৩৭)। বাড়ি আরাকান রাজ্যের জোহারাং এলাকার রাফিদং গ্রামে। উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবর তিনিও লোকমুখে শুনেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে তিনিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

বলেন, ‘বেঁচে থাকার আর কোনো স্বপ্নই ছিল না। সবকিছু হারিয়েছি। কী ছিল না আমার? সুখের সংসার বলতে যা বোঝায়- সবকিছুই ছিল। এখন কোনো কিছুই নাই।’

তিনি বলেন, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি চারদিন হলো। খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট। শিশুদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বাবা হিসেবে এর চেয়ে ব্যর্থতা আর কী আছে! কিন্তু ভিন দেশের প্রধানমন্ত্রী আজ আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আবার যেন বাঁচার স্বাদ পাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ‘ভাই, আমরা নিজ দেশে, নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে চাই। আপনারা সাংবাদিক, আপনারা আমাদের কথা লিখুন। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বৃদ্ধি করুন যাতে আমরা একটু শান্তিতে আমাদের মাতৃভূমিতে বসবাস করতে পারি। নিজ দেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করতে পারি।’

‘জীবন বাঁচতে এখানে আসছি। হিংস্র পশুও এমন আচরণ করে না, যা আমাদের সঙ্গে করা হয়েছে। আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কোনোরকম তিন সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কী হতে পারে?’

কথাগুলো বলছিলেন কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নেয়া সাজেদা বেগম (৪৫)। শেখ হাসিনা আসার খবর শুনেছেন কিন্তু যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা) যে মহানুভবতা দেখিয়েছেন, যে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন তা লোকমুখে শুনেছেন।

‘আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী যা করেননি তা করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’- যোগ করেন তিনি। দেশে ফিরে যাবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ কি ইচ্ছা করে নিজ মাতৃভূমি ছাড়ে। আসতে বাধ্য হয়েছি। যাওয়ার বিষয়টিও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। পরিস্থিতি ভালো হলে দেশে ফেরত যাব।’

কুতুপালং শিবিরে দেয়া বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃত দোষী তাদের খুঁজে বের করুন। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যা যা সাহায্য করা দরকার, আমরা তা করব।’

‘মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের শরণার্থীদের আশ্রয় দিলেও এ দেশের ভূমি ব্যবহার করে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হলে তা বরদাশত করা হবে না’- হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন শেখ হাসিনা।

আরাকান রাজ্যের জোহারাং এলাকার রাফিদং গ্রামের বাসিন্দা সাবেদ আলীও (৪০) প্রশ্ন রাখেন, আমাদের কি দোষ, আমরা তো মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না। আমরা তো শান্তি চাই। তাহলে কেন আমাদের দেশ ছাড়া করা হলো?

‘টাকার অভাবে বউকে আনতে পারিনি। নাফ নদীর ওপারে তাকে রেখে এসেছি। জানি না এখন সে কেমন আছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রীর কথা আমিও শুনেছি। আশার আলো যেন ফিরে পেয়েছি।’

‘আমিও দেশে ফেরত যেতে চাই। তিন সন্তানের কে কোথায়, তাও জানি না। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করি, তিনি যেন সফল হন’- যোগ করেন সাবেদ আলী।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর প্রায় তিন লাখ ৩৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সহিংসতায় ইতোমধ্যে তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ‘অমানবিক সামরিক অভিযান’র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করতে আগামীকাল বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরি বৈঠক ডেকেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান রাখাইন প্রদেশের সহিংসতার ঘটনাকে জাতিগত নিধন বলে সতর্ক করার পরই জরুরি বৈঠক ডাকল সংস্থাটি।

এদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অনেকে এখনও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রচণ্ড স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নবজাতক ও বাড়ন্ত শিশুরা।