‘ফোন দেয়ার পর জানতে পারলাম আমাদের ঘিরে রাখা হয়েছে’

কোনো রক্তপাত ছাড়াই শেষ হয়েছে র‌্যাবের দীর্ঘ ১৮ ঘন্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। নরসিংদীর শহরের গাবতলী উত্তরপাড়া এলাকায় জঙ্গি আস্তনা সন্দেহে ঘিরে রাখা বাড়িটিতে অবস্থানরত যুবকদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ অভিযান।

অভিযানে ঘটনাস্থল থেকে কোনো প্রকার অস্ত্র বা গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তবে আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গি সদস্যদের যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব।

তবে ওই তরুণদের স্বজনরা বলছেন, এরা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত নয়। পড়াশোনার সুবাদেই এখানে থাকা।

শনিবার সন্ধা ৬টার দিকে গাবতলী এলাকার দুবাই প্রবাসী মাঈনউদ্দিনের মালিকানাধীন একতলা বিশিষ্ট বাড়িটি ঘেরাও করে র‌্যাব-১১ একটি দল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাতেই আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হয়। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।

রোববার ১১টার দিকে একে একে পাঁচজনকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনা হয়। পরে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণকারী পাঁচ যুবক হলেন নরসিংদী চরাঞ্চলের চরদিঘলদী গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে সালাহউদ্দিন, নরসিংদী সদর উপজেলার চরভাসানিয়া এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে বাছিকুল ইসলাম,নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে আবু জাফর, গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে মাসুদুর রহমান ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকার মশিউর।

এদিকে অভিযান চলাকালে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা থেকে আবু জাফর নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান।

তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন-‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের বাঁচান। আমরা নিরপরাধ। আমরা আওয়ামী লীগের কর্মী। আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার। প্লিজ আমাদের বাঁচান। আমরা সাধারণ ছাত্র। প্লিজ, আমাদের উদ্ধার করুন।’

আবু জাফর মিয়ার ফেসবুকের আরেকটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন -‘সাংবাদিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্যারদের উদ্দেশে বলছি, আমরা নিরপরাধ। আমরা কখনো শিবির, জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ভালো করে জানিও না। আপনারা আমাদের সার্চ করুন। দেখুন কিছু পান কিনা। বাইরে থেকে আমাদের ছিটকারি লাগানো। প্লিজ, ছিটকারি খুলে আমাদের উদ্ধার করুন।’

অন্যদিকে নরসিংদীর গাবতলী জামিয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণীতে পড়তেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে মাসুদুর রহমান।

মাসুদুর রহমান বলেন, ’প্রাইভেট পড়তে সেখানে গিয়েছিলাম।সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে গিয়া দেখি বাইরে দিয়া দড়জা আটকানো। জানালা দিয়া বাইরে তাকাইয়া দেখি চারদিকে র‌্যাব ঘেরাও করে রাখছে। ভেবেছিলাম কোনো ঘটনা ঘটছে এই জন্য পুলিশ দরজা লাগাইছে। আমি এরপরও দেড় ঘণ্টার মতো পড়ছি। কিন্তু মাগরিব পার হইয়া গেলে দেখি আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে আরও পুলিশ জড়ো হচ্ছে। বাইরে থেকে ফোন দিতেছে এইখানে নাকি জঙ্গি পাওয়া গেছে। ফোন দেওয়ার পর জানতে পারলাম আমাদের ঘিরে রাখা হয়েছে। পরে সবাইকে ফোন দিলাম।’

খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে আসেন মাসুদের বড় ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রহমান মাসুম।

তিনি বলেন, ‘মাসুদ আগে গাজীপুরের পোড়াবাড়ির একটি মাদ্রাসায় পড়ত। বছর দুই আগে সে গাবতলীর এই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছে।’

ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রহমান মাসুম বলেন, ‘মাসুদ দাখিল পরীক্ষার্থী। সে সালাহউদ্দিনের কাছে প্রাইভেট পড়তে ওই বাড়িতে গিয়েছিল। সে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাকে জীবিত অবস্থায় বের করে আনেন। অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী তার বিচার করুন।’

একই কথা বললেন আবু জাফরের ভাই আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জাফর দ্বিতীয়। এখানে থেকে চাকরির চেষ্টা চালাচ্ছে। রাতেই ওই বাসায় আটকা পড়ার কথা জানায়। ফোন পেয়ে আমরা এইখানে আসছি। আমার ভাই জঙ্গি না। র‌্যাব পুলিশ চাইলে আমরা ভেতরে গিয়ে তাদের নিয়ে আসতে পারি।’

জোসনা বেগম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ওই বাসায় মেস করে থেকে কয়েকজন যুবক থাকেন। তারা এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতো। তারা জঙ্গিবাদে সম্পর্ক এমন কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি।’

তবে অভিযান শেষে সকাল ১১টায় র‌্যাবের মিডিয়া উইং কমান্ডার মুফতি মাহামুদ খান বলেছেন, ‘যুবকদের আত্মসমর্পণ করানোই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া সিলেটের আতিয়া মহলে যে জঙ্গিরা ছিল তাদের সঙ্গে এখানে অবস্থানরতদের যোগসূত্র রয়েছে। তার কিছু প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত এই পাঁচজনের মধ্যে কয়েকজন সেই জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই বাড়ির তিনটি কক্ষ তল্লাশি করে কোনো অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। আমরা আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করব।’