ফ্রান্সের যে গ্রামটিতে বসে বিপ্লব লালন করেন খোমেনি

চল্লিশ বছর আগে চলতি মাসে, ইসলামিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে একজন মানুষ ফ্রান্সের একটি নিভৃত গ্রামে নির্বাসিত জীবন শেষ করে ইরানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। প্যারিসের বাইরে একটি গ্রামে একটি সাধারণ ঘরে তিনি থাকতেন।

বাগানের ভেতর একটি আপেলগাছের নিচে পা আড়াআড়ি করে বসে তিনি দিন পার করে দিতেন। আর ভাবতেন একটি বিপ্লবের কথা।

ষাটের দশকে ইরান থেকে পালিয়ে আসেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল খোমেনি। তিনি মানুষকে যা তালিম দিতেন, তাতে শাহ শাসক ধরপাকড় চালাতে পারে বলে আতঙ্ক ছিল। তাই দেশ ছাড়তে তাকে বাধ্য হতে হয়েছিল।

এর পর কিছু দিন তুরস্কে থাকার পর তিনি চলে যান ইরাকে। কিন্তু ১৯৭৮ সালে সাদ্দাম হোসেন তাকে পবিত্র নাজাফ শহর থেকে তাড়িয়ে দেন।

পরবর্তী সময় প্যারিসের পশ্চিমে নোওপেলে-লি-চ্যাটুয়া নামের একটি ঘুমপাড়ানির গ্রামে তার শেষ আশ্রয় হয়। সে বছরের অক্টোবর থেকে ১৯৭৯ সালে তেহরানে ফেরার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন।

এ গ্রামটি থেকেই শান্তভাবে ইরানের শাহ বিরোধী বিক্ষোভকে উদ্দীপিত করতেন খোমেনি। এখান থেকেই তিনি ইসলামী বিপ্লব লালন করে গেছেন।

৬১ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী জন-ক্লঁ সিনটাস সে সময় আয়াতুল্লাহ যে সড়কে বসবাস করতেন, সেই বরাবরই একটি বাড়িতে থাকতেন।

তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে- লম্বা দাঁড়িওয়ালা, পরনে ঢিলা জামা ও মাথায় কালো পাগড়ি এক শিয়া ধর্মীয় নেতা মাঝেমধ্যে রাস্তায় হাঁটাচলা করতেন। ফ্রান্সের পুলিশ যাকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিয়ে রাখত।

সিনটাস বলেন, নোওপেলে-লি-চ্যাটুয়াতে বসবাস করা লোকজনসহ আমরা নিজেরা বলাবলি করতাম, কেন তাকে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? কেন শহরটাকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হলো? কেবল এই এক ব্যক্তির জন্য এত এত পুলিশ ও হেলিকপ্টার? কেন এত আয়োজন তা তখন আমাদের বোধগম্য ছিল না।

‘যদিও আমরা জানতাম- তিনি ইরানের শাহ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।’

সেই সময়ের তোলা রয়টার্সের ছবিতে দেখা যায়, খোমেনি আপেলগাছ তলায় একটি জাজিমে বসে আছেন। তার সামনে পারস্যের তৈরি জায়নামাজ। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন গোপনে আলাপ করছেন। তার ডান হাতে কালো চশমা ধরা ছিল, হাতটি হালকা নড়ছিল।

নিভৃত গ্রামটির আরেক বাসিন্দা মিশেল লেভারডেক বলেন, খোমেনি সম্পর্কে তখনকার নানা গল্প গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যদিও গ্রামটিতে তার থাকার কেন নিদর্শন এখন আর নেই। তবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পতনের ইতিহাসের ব্যাখ্যার একটি পর্যটন চিহ্ন সেখানে রয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আয়াতুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের বিভিন্ন বাণী এখনও দেখা যায়। একটি সাদামাটা বাড়িতে অবস্থানের আগে তারা এসব বাড়িতে ছিলেন। সাধারণ বাড়িটিতেও কয়েকটি মহৎ বাণীও দেখা গেছে। বাড়িটিতে মক্কার দিকে মুখ করা বিশাল জানালার অংশে এই বাণী লেখা।

মিশেল লেভারডেক নামের ওই নারী বলেন, নিজের থাকার জন্য একটি মাঝারি ছোট বাড়ি পছন্দ করলেন খোমেনি। যদি আমি ঠিক বলে থাকি, তা হলে সেটির পশ্চিম দিকে মুখ করা বিশাল একটি জানালা ছিল। কারণ পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে তিনি নামাজ আদায় করতেন।

তখন খোমেনির খবর সংগ্রহের জন্য পল টেইলর নামে রয়টার্সের এক তরুণ সাংবাদিককে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ফ্রান্সে খোমেনির চার মাস নির্বাসিত থাকার সময়ে তার সাক্ষাৎকার নিতে গ্রামটিতে সময় কাটান তিনি।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির নিজ দেশ তখন উত্তাল ও শাহ শাসকও পালাতে প্রস্তুত ছিল।

টেইলর বলেন, পুরো সময়টায় খোমেনিকে খুবই শান্ত দেখা গেছে। তিনি কখনও নিজের আবেগ দেখাতেন না। তিনি খুবই শান্ত ছিলেন, মনে হতো তিনি অন্যগ্রহে চলে যেতেন।

১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরান থেকে পালিয়ে যান রেজা শাহ পাহলোভি। এর সপ্তাহ দুয়েক পরে একটি চার্টার্ড এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইটে তেহরানের উদ্দেশে উড়াল দেন খোমেনি। এ সময় তার সঙ্গে একডজন সাংবাদিক ছিলেন।

তখন তাকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ ইরানের রাস্তায় নেমে আসেন।

সেই স্মৃতিচারণ করে টেইলর বলেন, যখন তারা ফ্রান্স ছাড়েন, তারা জানতেন না, তাদের বিমানগুলো করে ভূপাতিত করা হবে কিনা কিংবা তাদের তেহরানের মাটিতে নামতে দেয়া হবে কিনা।

দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে শাসন করে আসা রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ১৯৮৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে ইরানের দেখভাল করেন খোমেনি। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

নোওপেলে-লি-চ্যাটুয়াতে তার বসবাস করা বাড়িটি আগের মতোই সাদাসিধে আছে। সাদা বাড়িটির দরজা সবুজ রঙ মাখা হয়েছে। একটি সাধারণ কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে যেতে হয়।