বইপ্রেমের হালচাল || নাজমীন মর্তুজা

নাজমীন মর্তুজা : সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বাণী বলতে বলতে খুব কম বাঙ্গালী আছেন যে মুখস্ত করেননি, “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না” তবে বই প্রকাশের সাথে যারা যুক্ত তাদের সকলের একই কথা বইয়ের ব্যবসায় লাভের অংক কমেছে, সেই সাথে এটাও শুনতে পাচ্ছি, একটা কথা মাঝে মাঝে এফবিতে অনেকের পোষ্টে দেখি “বই পড়ার অভ্যাস দ্রুত কমছে।” ব্যক্তিগত ভাবে আমি এই আশঙ্কাটি পুরোপুরি মেনে নিতে পারলাম না। বর্তমানে ই-বুকস্ সহজ লভ্য হওয়ার জন্য ছাপা বইয়ের কেনাবেচা হয়ত আর আগের মত নেই, সেই সাথে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের ইংরেজী বইয়ের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি ও বাংলা বইয়ের চাহিদা হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। তবে ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় কিছু বই ছাড়া আধুনিক বাংলা সাহিত্যর চাহিদা পড়তির দিকে, এটা যখন শুনি সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হয়। গত চার বছর বই মেলায় গিয়ে বই কেনা বেচার সমাগমটা দেখিনি নিজ চোখে তাই হয়ত। যদি এমন হয়েই থাকে তবে বাংলা সাহিত্যিকদের আত্মসমীক্ষার দরকার আছে বৈকি। একটি বহুল আলোচিত বিষয় আসলে কেন কমছে তবে বাঙালির বই কেনার প্রবণতা ও পড়ার অভ্যাস। তার কারণগুলো অবশ্যই আলাদা দৃষ্টিকোন থেকে দেখা দরকার।

যদিও বলা হয়, বই আর পাঁচটা সামগ্রীর মত পণ্য, যা সাধারণত মলগুলিতে সাজানো থাকে। কিন্তু বই তো সে রকম অপরিহার্য জিনিস নয়। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া, তাই হয়ত জনপ্রিয় নয়, না কিনলেও কিছু যায় আসে না। আসল কথা হলো বিদ্যা চর্চার মানসিকতা, সময় সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। এখন বই পড়তে নয় জামা কাপড়ে একটা ট্রেন্ড এসেছে কবিতা লেখা, গান, ছড়া, স্লোগান, রুপকথা, বাণী সব স্কীন প্রিন্টের ছাপ, এমন জামা কাপড় গায়ে চাপালেন ব্যস সব পড়া হয়ে যায়। নিজেকে রবীন্দ্র কিংবা শরৎবাবুর ভক্ত বানিয়ে ঘোরা যায় সহজেই, সে ক্ষেত্রে সময় নষ্ট করে কে আর বই পড়ার দিকে ছুটবে শুনি! বিদ্যাচর্চার মানসিকতা সময় সুযোগ দিন দিন কমে আসছে, এর মূল কারণটি হলো, বাঙালী যখন বই কিনে পড়ে, তখন সে লিখতেও চায়। সে ক্ষেত্রে ফেসবুকে চোখ রাখলেই দেখা যায় সবাই লেখক, কিন্তু ভালো মানের বই বের হচ্ছে কিনা, লেখা হচ্ছে কিনা, তেমন বাছ বিচার করার মত মানদন্ডের মাপকাঠিতে বিচার করবার মত দাড়িপাল্লা কোন প্রকাশক বা প্রতিষ্ঠান আজো কি জন্ম নিয়েছে? তবে এটা ঠিক যে ব্যাঙের ছাতার মত প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠেছে, যদি লাভের অঙ্ক কমেই যাই তবে এই বানিজ্যে কেন আসা? নামী লেখকদের কথা বাদ দিলে, নতুন বা নবীন লেখকদের কথা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে “ এখন ফেলো কড়ি মাখো তেল “ নীতি চালু করেছে অনেক প্রকাশনা সংস্থা। অনেকের দাবী প্রকাশনার বেড়ে চলা খরচের ঝুঁকির সমান অংশীদার হতে বলা হচ্ছে সেই সব লেখকদের। বিনিময়ে তারা পাবেন সমমূল্যের বই, যা বিক্রিয় দায়ও তাঁদেরই। যত শত বই বের হয়, হচ্ছে সে ক্ষেত্রে বই সংরক্ষণ বা রক্ষণা বেক্ষণও খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। ছোট ছোট ঘরগুলোতে বিরাট জায়গা জুড়ে থাকা বইয়ের সম্ভার পরবর্তী প্রজন্ম কি রাখতে চাইবে। কারণ নতুনদের পেশা বৃত্তি, শিক্ষা, রুচি, আলাদা, ফলে সব বিষয়ের বইয়ে তাদের আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ফুটপাথের পুরোনো বইয়ের দোকানে যখন যেতাম কত কত বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের সারি। তারা মারা যাওয়ার পর হয়ত বাড়ির লোক সব বেঁচে দিয়েছে। বইয়ের শেষ পরিণতি বা অনিবার্য নিয়তি মনে হয় তাই হয়। অনেকেই হয়ত মনে করেন বিপুল অর্থ ব্যয় করে বই কিনে ঘর জডো করা অর্থহীন। আর পশুশ্রম তো বটেই! যারা জোগাড় করে তাঁরাই জানে বিশেষ বিশেষ বই জোগাড় করা কতটা পরিশ্রম সময় ও টাকা লাগে। তবে নতুন প্রজন্মের পছন্দ ট্যাবলেটের বই, খুব সুবিধে তাতে তারা শক্তি চট্টাপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায়, বই পড়ে বই মুছে ফেলে! তাই জন্য হয়ত বা বই ক্রেতা বাঙালী পাঠক এক লুপ্ত শ্রেণীর প্রাণী হয়ে ওঠার পথে পা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে একসময় যখন আজিজ সুপার মার্কেটে যেতাম তখন বইয়ের গন্ধে মন ভরে যেতো এখন যায় পোষাকের গন্ধে । এমন পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল তবে কি বই বাজার বিলুপ্ত হয়ে যাবে? যে হারে রাজধানীতে বিদেশী খাবারের রেঁস্তোরার বিপুল চাহিদার পাশাপাশি অঙ্গুলি পরিমেয় “ বুক স্টোর” বই বিপণি ক্রমবিলুপ্তির প্রমাণ স্বরূপ সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া যায় সহজেই । ভবিষ্যতে বাঙালির বই প্রেম নিয়ে আর কিছু বলার জায়গা থাকবে না হয়ত।

এ কথা অনস্বীকার্য, প্রকৃত পাঠক বা বই প্রেমীর সংখ্যা বর্তমানে কোনও পরিসংখ্যান দ্বারা পরিমেয় নয়।

অথচ নিয়ম করে বইমেলা হয়, বইমেলা উপলক্ষে এবং নববর্ষে বই প্রকাশ তো চিরায়ত রেওয়াজ আমাদের। কিন্তু বিশেষ কোন বই নিয়ে হামলে পড়া বা সেই সব বই সংগ্রহের জন্য বই- বিপণিতে সর্পিল লাইন পড়ার দৃশ্য কি চোখে পড়ে? বাংলাদেশের একুশের বই মেলাতেই মনে হয় কেবল পাঠকের সাগ্রহ বিকিকিনি বা বই বিক্রির পরিসংখ্যান পাঠে বিশ্বাস করতে চমকে উঠতে হয় বই কি ।
আমরা দেখি যে বই দোকান না গিয়ে মানুষ, এমনি বহু চিত্রতারকা আঁকিয়ে, শিল্পী নামী রেঁস্তোরা খুলেছেন, বুটিক সাজিয়ে বসেছেন, কিংবা বিউটিপার্লার, কিন্তু কেউই একটা অভিজাত বই – বিপণি খোলার কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। কিংবা ঢাকার মল গুলোতে ঝাঁ ঝকঝকে বিপণি গুলোতে হাজারো ক্রেতা এমনকি ভ্রমনকারি নিয়মিত উইন্ডো শপিং করেন। ভাবা যায় একটা মোহিত হওয়ার মত বুক স্টোর থাকলে কি হতো? যতটা দেখা যায় মানুষ রেঁস্তোরা গিয়ে খাবারে নাক ডুবাচ্ছেন, তখন কিছুক্ষণ কল্পনা করা যেতেই পারে ইস যদি এই রকম একটি বই বিপণির কথা, যেখানে মগ্ন পাঠক বই বাছছেন,

কিনছেন বা দেয়ালে হেলান দিয়ে প্রিয় বইয়ে চোখ বুলাচ্ছেন। হাতে হাল্কা পানীয় চা কফির পেয়ালা। সেখানে খাবার রেঁস্তোরার সহাবস্থান থাকবে না। বাজবে মৃদু সঙ্গীত। ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু ব্যবসায়ীরা। মনে হয় মাঠে মারা যাবেন না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সাথে টেক্কা দিয়ে যদি মল বানাতে পারে, তবে আধুনিক বই বিপণি বানাতে কেন পিছিয়ে থাকবে? যতটুকু ধারনা করা যায় থাই ইতালী চাইনিজ খাবার চেটেপুটে খাওয়ার লোক যেমন আছে, অপর দিকে জ্ঞান পিপাসু পাঠকও কিন্তু ডাইনোসরের মত বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ফলে প্রকাশকরা আর বলবেন না বই ব্যবসা নাশের ব্যবসা, সৈয়দ মুজতবা আলী মজা করে একটা কথা বলেছিলেন যে, ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।’ হয়ত এটাই ঠিক।