বই লাগবে বই? ওরা বইপ্রেমি একঝাঁক ফেরিওয়ালা শিক্ষার্থী

বই লাগবে? বই, হরেক রকমের বইবই লাগবে? বই? হরেক রকমের বই। টাকা দিতে হবে না! শুধু পড়া শেষে বইটা দিয়ে দেবেন আমাদের। নাহ, নাহ, ভয় পাবেন না! নির্দিষ্ট কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। আপনার যখন পড়া শেষ হবে, তখন দিলেই চলবে।

এভাবেই বই ফেরি করে চলেছেন একদল শিক্ষার্থী। তবে রাস্তায়-রাস্তায় না। তারা বই ফেরি করেন ফেসবুকে! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে প্রচারণা চালিয়ে এ সময়ের শিক্ষার্থীদের বই পড়ার আহ্বান জানান তারা।

এভাবে আগ্রহী পাঠকদের পিপাসা মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এক দল ফেরিওয়ালা। এমন কাজ করে যাচ্ছেন যারা, তারাও সবাই শিক্ষার্থী।

ফেরিওয়ালাদের মত তাদের কাঁধে ঝুলে থাকে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি হরেকরকম বই। ক্যাম্পাস জুড়ে হেঁটে বেড়ায় তারা। বইপ্রেমিরা তাদের খুঁজে নেয়। আবার তারাও খুঁজে বের করে বইপ্রেমিদের। বই ধার নেয়। পড়ে ফিরিয়ে দেয়। এভাবেই চলে তাদের বই ফেরি করার কাজ। ওরা বইয়ের ফেরিওয়ালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এরা পরিচিত মুখ। ছয় জনের একটি দল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের, বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র-ছাত্রী তারা। আপনি আপনার পছন্দের বইটি পাবেন এদের কাছে। শুধু পায়ে হেঁটেই নয় ফেসবুকে গ্রুপ খুলে বই দেয়া-নেয়ার কাজটি করছে তারা।

এর জন্য দিতে হয়না কোন অর্থমূল্য বা জামানত, নেই সদস্য হওয়ার কোন ঝামেলা। শুধু ঠিকানা এবং মুঠোফোন নম্বরের বিনিময়েই এই ফেরিওয়ালাদের থেকে মিলবে বই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বই নেওয়ার সময় পাঠকই নিজের সুবিধা মতো বই ফেরতের তারিখ ঠিক করে দেবেন। অভিনব ও চমৎকার উদ্যোগটি সজল কুমার নামের বইপ্রেমী এক তরুণের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ছোটবেলা হতেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তার। তবে কেবল নিজে বই পড়ে নয়, অন্যকে পড়ার ব্যবস্থা করতে পারার মধ্যেই তার আনন্দ। আর সে কারণেই তিনি বইয়ের ফেরিওয়ালা।

এ প্রসঙ্গে সজল জানালেন, তার এই স্বপ্নযাত্রায় পাশে পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও পাঁচ বইপ্রেমিকে। এরা হচ্ছেন- লিপ্টন মন্ডল, শান্তু ঘোষ, সামস সাহেলা, ফোরকান হোসাইন ও শরীফ হোসেন। সবাই মিলে তারা বই ফেরি করেন। তাদের সংগ্রহে রয়েছে পাঁচ শ’রও বেশি বই। যার অধিকাংশই সজলের নিজের।

হঠাৎ ভাবনায় এলো, বইগুলো রুমে ফেলে না রেখে বন্ধুদের পড়তে দেওয়া যায়। বিভাগের বন্ধুদেরই প্রথম বই দেওয়া শুরু করি। সেটা ২০১৬ সালের কথা। এরপর ধীরে ধীরে অন্য বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরাও বই নিতে শুরু করেন। এখন সপ্তাহে ৪০-৫০ জন আমাদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েন,” বলেন সজল। তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থী এই বই পড়ার আয়োজনের অংশীদার হোক।

এই কার্যক্রমের অংশ হতে পেরে দারুণ খুশী গ্রুপের অন্য সদস্যরাও। গ্রুপের একজন সদস্য সামস সাহেলা তার ভালো লাগার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “পাঠকরা যখন নিজ থেকে বই নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন মনে হয় আমাদের পরিশ্রম সার্থক”। সকল পাঠককে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে ফেসবুকে ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’ নামে খোলা গ্রুপে বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপের মাধ্যমেই বইয়ের অর্ডার আসে যা পরে উদ্যোক্তারা হাতে হাতে পৌঁছে দেন।

ফেসবুক গ্রুপে লেখকের নামসহ বইয়ের তালিকা দেওয়া রয়েছে। যার বেশিরভাগ বাংলা সাহিত্যের বই। তালিকার নিচে কমেন্ট বক্সে বইয়ের নাম, নিজের নাম ও মুঠোফোন নাম্বার দিলেই ফেরিওয়ালাদের পক্ষ থেকে কল আসে। এরপর সময় ও ক্যাম্পাসের কোনো একটি স্থান নির্ধারণ করে আগ্রহী পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া হয় বই।

তাদের কার্যক্রম শুধু বই দেওয়া-নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। বইয়ের ফেরিওয়ালার রয়েছে একটি ইউটিউব চ্যানেল যেখানে বিভিন্ন বইয়ের পরিচিতি, রিভিউ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তারাও যেন বইয়ের সান্নিধ্যে আসতে পারে সেজন্য বই পাঠের অডিও ক্লিপও রয়েছে এখানে।

এছাড়া বইপাঠ প্রতিযোগিতা, সাহিত্য ভাবনা, চিঠি উৎসব সহ নানান ধরণের ইভেন্ট আয়োজন করেন তারা। সকল আয়োজনই তরুণদের বই পাঠে আগ্রহী করে তোলার জন্য।

সজল কুমার বলেন, “বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্ম মুঠোফোনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত। চারদিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতা, মাদকের ছোবল। এর থেকে উত্তরণে বই হতে পারে দারুণ সমাধান।” কাজটি করতে গিয়ে কিছু সমস্যায়ও পড়েন দলের সদস্যরা। তাদের একজন শান্তু ঘোষ জানান, প্রায় সময়ই অনেকে বই নেওয়ার কথা বলে পরে আর নিতে আসেনা অথবা বই পড়ে ঠিক সময়ে ফেরত দেন না।

তাদের এই আয়োজনকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন অপর উদ্যোক্তা ফোরকান হোসাইন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে চান তারা। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা বইয়ের ফেরিওয়ালা কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানান সজল কুমার।