ঋণের বোঝা ও মামলার ঘানি কৃষকের ঘাড়ে!

বসতভিটা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মিঠাপুকুরের আখিরাহাট সমবায় সমিতি’র সদস্যরা

মো: শামীম আখতার, উপজেলা প্রতিনিধি, মিঠাপুকুর (রংপুর) : ‘দেশের ১’শ জন ঋণ খেলাপি ব্যক্তির কাছে ১ লাখ কোটি টাকা আছে। কেউতো তাদের নামে মামলা করেনা, তাদের ওয়ারেন্টও হয়না। মামলা হয় আমার মত হত দরিদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে! একের পর এক লিগ্যাল নোটিশ, মামলা ও ওয়ারেন্টের জ্বালায় আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করে।’ -বলছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের আখিরাহাট সব্জী বাজার কালেকশন পয়েন্ট সমবায় সমিতি’র সদস্য মাহবুবুল আলম। শুধু মাহবুবুল আলমই নয়-ওই সমবায় সমিতি’র ৫৫ জন সদস্যের অবস্থা একই। তারা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আম ও ভুট্টা চাষের জন্য ঋণ নিয়ে মামলা ও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেক কৃষক ঋণ, সুদ, মামলা খরচ ও দৌড়ঝাঁপ করতে বিক্রি করেছেন বসতভিটা। এমনি একজন ময়েনপুর পূর্বপাড়া গ্রামের লাবলু মিয়া। ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড’র রংপুর শাখা হতে ভুট্টা চাষের জন্য ৬২ হাজার ৮শ ৩৯ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কালবৈশাখি ঝড়ে এলাকায় ভুট্টা ও আমক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। সময়মত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে পাঠানো হয়েছে ৪টি লিগ্যাল নোটিশ। ঢাকায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। পরে বাধ্য হয়ে তাঁর ১৫ শতক বসতভিটার অর্ধেকটা বিক্রি করে সুদ, আসল ও মামলা পরিচালনার খরচ বাবাদ ৯৯ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করেন। অনেকে ঋণের সুদ-আসল ও মামলা পরিচালনা ব্যায় বহন করতে নিঃস্ব হয়েছেন।

আখিরাহাট সব্জী বাজার কালেকশন পয়েন্ট সমবায় সমিতি সূত্রে জানা গেছে, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড রংপুর শাখা ২০১৩ সালে সমিতি’র সদস্যদের হাঁড়িভাঙ্গা আম ও ভুট্টা চাষের জন্য ৩ কিস্তিতে ৬ মাস মেয়াদী ঋণ প্রদান করে। ফসল ঘরে ওঠার পর ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করেন সদস্যরা। এভাবে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের ঋণ গ্রহন ও পরিশোধ করা হয়। ২০১৫ সালের শেষের দিকে আবারও সদস্যদের ঋণ প্রদান করে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড। ওই বছর কালবৈশাখী ঝড়ে হাঁড়িভাঙ্গা আম বাগান ও ভুট্টা ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। এতে, ঋণের টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষকেরা। তারা বিষয়টি ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের কর্মকর্তাদের জানান। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে কর্মকর্তারা সুদ মওকুফের জন্য সদস্যদের আশ্বস্ত করেন। ২০১৬ সালে শুরু হয় সদস্যদের নামে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো। চলতি বছরে ঢাকার একটি আদালতে মামলা হয় ময়েনপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর উত্তরপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামান, একই গ্রামের আব্দুল হাকিম, হাফিজুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, ইদ্রিস আলী, ময়েনপুর পূর্বপাড়া গ্রামের লাবলু মিয়া ও আবু বক্কর সিদ্দিকসহ প্রায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ৫ জন জমাজমি ও বসত ভিটা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন। পরবর্তিতে চলতি বছরে সমিতি’র প্রায় ৪৫ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড।

সমিতির সদস্য অভিযোগ করে বলেন, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে ৬ মাসে ৩ কিস্তিতে ঋণ প্রদান করে। পরে শতকরা ২২ টাকা হারে সুদসহ একত্রে টাকা আদায় করে থাকেন। এভাবে আমরা ২ বার ঋণ গ্রহন ও সময়মত টাকা পরিশোধ করি। কিন্তু, ২০১৫ সালে কাল বৈশাখী ঝড়ে আম বাগান ও ভুট্টা ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। এরফলে, একাধীকবার লিগ্যাল নোটিশ ও মামলা দায়ের করেছে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে ৩৫ জন সদস্যের নামে ওয়ারেন্ট হয়েছে। তারা বসতভিটা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

সমিতি’র সদস্য কামরুজ্জামান, মোজাফ্ফর হোসেন, আব্দুল হাকিম ও হাফিজুর রহমান বলেন, মামলা করায় ঋণ ও সুদ পরিশোধ করি। এছাড়াও তারা মামলা পরিচালনা ব্যায় বাবদ ১৫ হাজার ও মামলা নিস্পত্তির জন্য আরও ২০ হাজার টাকা জোরপূর্বক আদায় করেছে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ।

ময়েনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ও খোড়াগাছ ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বলেন, ওই সমিতির সকল সদস্য অশিক্ষিত। ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড রংপুর শাখা প্রতারণার মাধ্যমে সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এদের মধ্যে বেশিভাগ সদস্য ওই মামলাগুলোর ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী। তারা বসতভিটা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আখিরাহাট সব্জী বাজার কালেকশন পয়েন্ট সমবায় সমিতি’র সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা ও ওয়ারেন্টের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। উপজেলা নির্বাহি অফিসার হারুন-অর-রশীদ বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, তারা ঋণ গ্রহন করেছিল। পরিশোধ না করায় প্রথমে তাদেরকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। এরপরও টাকা পরিশোধ না করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।