বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে উধাও ভূমি কর্মকর্তা

জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের প্রায় ১৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছেন সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলাম। এর মধ্যে পরপর দুই দিনে তিনি সোনালী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখা থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা তুলে বস্তায় ভরে নিয়ে গেছেন। এর আগে তিনি প্রায় আট কোটি টাকা সরিয়ে নেন। এ ছাড়া আরও ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য ব্যাংক চেক তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি পালিয়ে যান। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সেতাফুল ইসলামের আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ অর্ধশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। খবর প্রথম আলো’র।

সেতাফুল ইসলামের মুঠোফোন বন্ধ। তাঁকে খুঁজে না পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অভিবাসন (ইমিগ্রেশন) বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এম বজলুল করিম চৌধুরী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয়, আইনানুগ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এমন ভয়ংকর ও অসৎ লোক আমি জীবনে দেখিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে) মামলা করার অনুরোধ জানিয়েছি।’

যেভাবে আত্মসাৎ
ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সেতাফুল ইসলামের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করছে। আত্মসাতের এই ঘটনায় সেতাফুল ইসলাম ছাড়াও কিশোরগঞ্জ জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের নিরীক্ষক বা অডিটর সুপার এস এম জামান, গোলাম হায়দার, জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম এবং সোনালী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখার কর্মকর্তারা দায়ী বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় এই কাজ করে দেয়। জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এ জন্য জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অগ্রিম চেক পাঠাতে হয়। সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলাম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন।

ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ ডিসেম্বর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার স্বাক্ষরে ক্ষতিপূরণের পাঁচ কোটি টাকার একটি চেক ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা শিরোনামে জমা দেওয়া হয়। এরপর গত ৬ ও ৭ ডিসেম্বর দুই দফায় ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেন সেতাফুল ইসলাম। বাকি ছয় লাখ টাকা তপন ইন্ডাস্ট্রিজের নামে একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জের হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে ১০ কোটি টাকার অপর একটি চেক সই করে তা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের জালিয়াতি ধরা পড়ায় ১০ কোটি টাকার ওই চেক জেলা প্রশাসনের হেফাজতে নেওয়া হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরাসরি অর্থ তুলে নেওয়া ছাড়াও সেতাফুল ইসলাম ক্ষতিপূরণের চেক নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম করেছেন। গরমিল করে ক্ষতিপূরণের টাকা জমির মালিককে দিয়েছেন, অনেক চেক জমাই দেওয়া হয়নি। অনেক চেকের মুড়িতে প্রাপকের প্রাপ্তিস্বীকার নেই, অনেক ক্ষেত্রে আবার প্রাপকের অংশ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার নিজ হেফাজতে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১৩টি চেক কোথাও পাওয়া যায়নি। এগুলো সেতাফুল ইসলামের কাছে রয়েছে। আবার মালিকানা অনুযায়ী চেক বিতরণ না করে বেনামে চেক বিতরণের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এভাবে সেতাফুল ইসলাম আরও ৮ কোটি ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৬৩৮ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে।

ব্যাংক থেকে বস্তাভর্তি টাকা
সেতাফুল ইসলাম টাকা তুলতে ব্যাংকে গিয়েছিলেন বস্তা ও গাড়ি নিয়ে। আর এ বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) নুরুন্নবী। তিনি বলেন, যা হয়েছে তা ব্যাংক ও জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, সেতাফুল ইসলামকে কীভাবে তাঁর নিজের নামে এতগুলো টাকা একেবারে ব্যাংক দিয়ে দিল। একই ভবনে ব্যাংক ও জেলা প্রশাসনের কার্যালয়, তবু কেন তারা জেলা প্রশাসককে জিজ্ঞেস করল না।

তবে দায় অস্বীকার করে কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক মো. মাহবুবুল ইসলাম খান বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে হিসাব পরিচালনার টাকা ওঠানোর এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তাই দেওয়া হয়েছে। আর তিনি নিজের হাতে চেকে সই করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দিয়েছেন, তাই আমরা টাকা দিতে বাধ্য। এর চেয়ে বেশি টাকাও যে কেউ তুলতে পারে।’

এত টাকা কীভাবে নিলেন, জানতে চাইলে শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, ওই ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে গাড়ি, লোক ও বস্তা নিয়ে এসেছিলেন। সেই বস্তায় করেই টাকা নিয়েছেন।

আর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামও নিজের দায় অস্বীকার করে বলেন, ‘সেতাফুল ইসলাম অগ্রিম চেক নিয়ে এসেছিলেন, আমি চেকটার সঠিকতা যাচাই করেছি। ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার পর তাঁর এ বিষয়ে বিস্তারিত হিসাব দেওয়ার কথা। আমি তো বুঝিনি তিনি এত বড় অবিশ্বাসের কাজ করবেন।’

তবে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুন্নবীর মতে, ‘আমি মনে করি, ব্যাংক এ ঘটনার সঙ্গে অবশ্যই জড়িত। এ ছাড়া জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ই-বা কীভাবে এই চেকে অনুমোদন দিল। চেক তো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নামে হওয়ার কথা। তাই তাদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা দরকার।’

বদলি অপছন্দ
বদলি অপছন্দ ছিল সেতাফুল ইসলামের। গত ৩ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে সেতাফুল ইসলামকে পিরোজপুরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি দুই দফায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা তুলে নেন। এর আগে সেতাফুল ইসলামকে গত ১৯ অক্টোবর শেরপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তদবির করে পদোন্নতি বাতিল করান। পরে তাঁর পছন্দের পদ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে বদলি করা হয়।

খোঁজ নেওয়া হলে তাঁকে কিশোরগঞ্জ বা পিরোজপুর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আহমদ ছিদ্দিকী বলেন, ‘সেতাফুল ইসলাম পিরোজপুরে যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি। শুনেছি, তাঁকে ভোলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।’ তবে ভোলার জেলা প্রশাসক সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘সেতাফুল ইসলামকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন ওয়েবসাইটে দেখেছি। বাস্তবে তাঁকে অফিসে দেখিনি।’

সব মিলিয়ে সেতাফুল ইসলামের অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ কত, তা নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্র বলছে।