বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে ‘ভেগেছে’ বেশকিছু রোহিঙ্গা

সেনা অভিযানের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নেয়া বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবারের পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একাংশ আবার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারাই এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন,যেসব রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারে স্বচ্ছল জীবন যাপন করেছে, তারাই মুলত ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা উখিয়ার বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার চেষ্টা করছে।

এদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাদের ছেলে-মেয়ে চাকরি করছে তারা ভুয়া কাজগপত্র তৈরি করে বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় আছে বলেও তথ্য মিলেছে। এর আগেও বহু সংখ্যক রোহিঙ্গার এই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশ গেছে বলে প্রমাণ মিলেছে।

স্থানীয় পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এস গফুর উদ্দিন বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৫ শতাংশের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো, বিশেষ করে যাদের ছেলে-মেয়েরা আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। এই পরিবারগুলোই দালালের সহায়তায় গোপনে ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা করছে।

হাছু মিয়া নামের এক রোহিঙ্গা জানান, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ইতিমধ্যে দুই শতাধিক পরিবার ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছে।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ নুর জানান, গত এক মাসে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে দেখা যাচ্ছে না। এদের মধ্যে কুতুপালং ডি-১ ব্লকের মো. জুবাইর, মো. আলম, নুর মোহাম্মদ, আব্দুল লতিফ, মো. ইউছূপ, আবু তাহের, মো. আবু তাহেরসহ অনেকেই মালয়েশিয়া চলে গেছে বলে জানতে পেরেছেন মোহাম্মদ নুর।

এছাড়া কুতুপালং ই-২ ব্লকের আতাউল, আলী জুহার সৌদি আরবে, ছৈয়দ নুর, নুরুল আলম, কামাল উদ্দিন কাতার চলে গেছেন বলে জানতে পেরেছেন মোহাম্মদ নুর।

কীভাবে তারা বিদেশ গেলেন-জানতে চাইলে আবদুল আমিন নামে এনজন রোহিঙ্গা জানান, প্রবাসে অবস্থানরত তাদের স্বজনেরা পাসপোর্ট ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

স্থানীয় অভিযোগ, আইনশৃংখলা বাহিনী ও পাসপোর্ট সংশ্লিষ্টদের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বিদেশে পাঁড়ি জমাচ্ছে।

জানতে চাইলে রোহিঙ্গাভিত্তিক পুলিশ বিশেষ শাখার উপপরিদর্শক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কথা শুনেছি। পাসপোর্ট অফিস থেকে যেসব কাগজপত্র ভেরিফিকেশনের জন্য আমাদের হাতে আসছে তা খুবই যত্ন সহাকারে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। চৌকিদার, দফাদার, মেম্বারও চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে যাতে ভুলক্রমেও কোন রোহিঙ্গা নাগরিক বিদেশে যেতে না পারে।’

বালুখালী কুতুপালং এর একাধিক রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান তারা। কারণ, মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস রয়েছে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার নিরাপত্তা দেবে-এমন কথা বিশ্বাস হচ্ছে না দেশটির অতীতের নানা কর্মকাণ্ডের কারণেই।

তবে ক্যাম্পে আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গাই হতদরিদ্র। তারা মিয়ানমারের চেয়ে এখানে ভালো আছে। তবে তারা নিজ দেশে বসতভিটা ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ পেলে ফিরে যেতে আগ্রহী।

কুতুপালং ক্যাম্পে আশিত্র রোহিঙ্গা নাগরিক জাফর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির উপর নির্ভর করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। যাদের বেশি টাকা আছে তারা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া বসবাস করছে। পরে সুবিধামত সময়ে ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। যারা আর্থিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছল তারা প্রত্যাবাসনে নিরোৎসাহীত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া উপজেলা সদর রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের চার হাজার একর বনভূমির উপর একত্রিত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্রে চলে যেতে না পারে সেজন্য আইনশৃংখলা বাহিনীকে আরো সজাগ থাকতে হবে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যাওয়া ঠেকাতে তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর লোকজন যাত্রীবাহী গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আইডি কার্ড, নাম-পরিচয়, এমনকি চেয়ারম্যান-মেম্বারের নাম জানা আছে কি না জানতে চাইছে। যারা বলতে পারছে না তাদেরকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’