বাংলাদেশী শিল্পীদের জন্য খুলে যাচ্ছে ভারতের বাজার?

জেবুন এন নাঈম । এলহাম খুকু । রুবিনা আখতার । তিনজনই নারী, এবং বাংলাদেশের শিল্পী। আর এই মুহুর্তে তাদের মিলিত চিত্রপ্রদর্শনী হচ্ছে দিল্লির নামকরা গ্যালারিতে – ভারতের রাজধানীতে এই প্রথমবারের মতো।

আর শুধু প্রদর্শনীই নয়, তাদের ছবি নিয়ে ভারতে তুমুল আগ্রহও তৈরি হয়েছে।

তাদের আঁকা তেলরঙ, পেন-কালি, কাঁথা কিংবা ওয়াটার কালারের সৃষ্টিগুলোও বেশ ভাল দামে কিনছেন ভারতের শিল্পরসিকরা।

ভারতে গত কয়েক বছরে শিল্পকলার বাজার যে অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশও যে একটা অংশ অনায়াসেই দখল করতে পারে – অনেকেই এটাকে তার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন।

দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটি’তে (আইফ্যাকস) এই মুহুর্তে বাংলাদেশী চিত্রশিল্পীদের যে প্রদর্শনীটি চলছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য হোপ’ বা আশা।

প্রদর্শনীর কিউরেটর কাজী এম রাগিব গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “আমি দেখেছি শিল্প সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আগ্রহ, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক শিল্পের বাজারটা সেখানে বেশ সঙ্কুচিত।”

“এতদিন বাংলাদেশের শিল্পীরা তাদের আর্ট বেচার জন্য দুবাই, তুরস্কর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেন। কিন্তু ঘরের পাশে ভারতেও যে একটা বিরাট শিল্প বাজার আছে, তার দরজাটাই আমরা বাংলাদেশের জন্য খুলে দিতে চাইছি।”

প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসেছিলেন ভারতের ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে’র মহাপরিচালক অদ্বৈত গাডানায়ক।

তারও বলতে দ্বিধা নেই, “বাংলাদেশের শিল্পীদের ছবিগুলো যদি দেখি, তাহলে দেখব ছবির সাবজেক্ট বা ফিলঅসফি হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদেরই মতো। কিন্তু দর্শন বা বিষয়বস্তুতে এক হয়েও কোথাও যেন ছবিগুলো আলাদা।”

“মানে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মনে হবে একই ধরনের ছবি – কিন্তু আসলে ঠিক তা নয়।”

“আর এই ধরনের নিয়মিত আদানপ্রদানের মাধ্যমেই বাংলাদেশের শিল্পকলা আরও বেশি করে ভারতে জায়গা করে নিতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।”

কিন্তু ঠিক কোথায় আলাদা বাংলাদেশের শিল্পকলা ? ভারতের শিল্পবাজারেই বা তা নতুন কী বৈশিষ্ট্য আমদানি করতে পারে?

চিত্রশিল্পী এলহাম খুকু সরাসরি জবাব দেন, “দেখুন, ভারতে শিল্পচর্চার সঙ্গে ধর্মের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে আবহমান কাল থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের ছবি আঁকতে হয় ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে গিয়ে।”

“এই কারণে বোধহয় আমাদের আঁকার ঢংটাও আলাদা। হয়তো আমরা ন্যুড আঁকতে পারি না ধর্মীয় বাধার কারণে।”

“অনেক বাধাবিপত্তি থাকে, তারপরেও আমরা রাধাকৃষ্ণ আঁকি, বিশেষ ধরনের রং ব্যবহার করি।”

“কিন্তু এই বাধাবিপত্তিই হয়তো আমাদের ছবিতে একটা নতুনত্ব এনে দেয়, একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে। আর সেখানেই ভারতের চেয়ে কোথাও একটা আলাদা হয়ে যায় বাংলাদেশের ছবি”, বলছিলেন এলহাম খুকু।

‘দ্য হোপ’ প্রদর্শনীতে তার সহশিল্পী রুবিনা আখতারও একমত, সম্ভবত এই কারণেই ভারতে বিশেষভাবে সমাদৃত হচ্ছে তাদের শিল্পকর্ম। দিল্লির শিল্পরসিকরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে সেই সব ছবি দেখছেন, কিনছেন।

রুবিনা আখতার বলছিলেন, “আমরা ভারতে এতটা ফিডব্যাক পাব কখনও কল্পনাই করতে পারিনি। যেভাবে এই প্রদর্শনীতে শিল্প সমঝদাররা আসছেন, প্রশ্ন করছেন কিংবা নানা বিষয় খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন তাতে আমরা সত্যিই আপ্লুত।”

ভারতে গত এক দশকে আর্ট বা শিল্পকলার বাজার নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গেলেও আকারে অনেক বেড়েছে।

ভারতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভাল পেইন্টিং বা আর্টওয়ার্কের চাহিদা।

সে কর্পোরেট অফিসেই হোক বা নবীন মিলিওনিয়ার, অরিজিনাল ভাল ছবি নিজেদের সংগ্রহে রাখতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ভারতীয়রা।

তার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেও অনেকে দ্বিধা করছেন না।

বাংলাদেশ এই বাজারের একটা অংশ অনায়াসেই পেতে পারে, বিশ্বাস করেন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীও।

‘দ্য হোপ’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসে হাই কমিশনার আলী বলছিলেন, “আমাদের শিল্পীদের ছবিগুলো দেখবেন – তিনজনেই কিন্তু এঁকেছেন বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ, জলহাওয়া নিয়েই।”

“সব ছবিতেই ফুটে উঠেছে আমাদের প্রমত্তা নদী কিংবা রমণীর সৌন্দর্য – কিন্তু সেটাকে সবাই দেখেছেন আলাদা আলাদা চোখে, আর সেখানেই ছবিগুলো অনন্য হয়ে উঠেছে।”

শিল্প বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, বিষয়বস্তুতে অনেকটা এক হলেও দৃষ্টিভঙ্গীর এই স্বকীয়তাই বোধহয় ভারতের শিল্প বাজারে বাংলাদেশী শিল্পকলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ!

-বিবিসি বাংলা